
সেন্সিটিভ ইনজুরি, ইনজুরিটা মাথায়! অ্যাম্বুলেন্স থামল হসপিটাল কম্পাউন্ডের এন্ট্রি গেটে। ইমারজেন্সির এন্ট্রি গেট ওটা। স্ট্রেচারে শুয়ে ঘন ঘন নিঃশ^াস ফেলছি। ডুবে যাচ্ছি মৃত্যুর গহ্বরে, একা! ওয়ার্ডবয়রা যে কখন আমাকে ইমারজেন্সিতে নিয়েছে, একটুও টের পাইনি। তবে আমি সেন্সলেস হইনি! শব্দের অস্তিত্ব বুঝতে পাচ্ছি। গ্লাভস পরা বেশ কটা হাত আমার সারা শরীর ছুঁয়ে দেখছে ইচ্ছেমতো। কিন্তু স্পর্শগুলো ভীষণ অচেনা, আউটডোর ডাক্তারদের হবে হয়তো! পা দুটো ভারি ভারি লাগছে, হাত দুটোও খুব একটা রেসপন্স করছে না আগের মতো। হৃৎপিণ্ডও কি স্থবির হয়ে যাবে? এক দুর্বিষহ সময়ের বুকে মাথা রেখে চারপাশটাকে বোঝার খুব সাধ জেছে উঠছে কেন জানি! আজ থেকে তবে কি আমাকে বাইন্ডিং লাইফ লিড করতে হবে? টেনশন ফিল করছি। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী জীবনের ইকুয়েশন বড়ই বোরিং। ব্যথা হচ্ছে, জ্যামিতিক ব্যথা! পুরো শরীর দুমড়ে মুচড়ে আসছে। খচখচ করছে ভেতরকার এক একটা কোষ ও অণুকোষ। নিঃসঙ্গতাগুলো সমান্তরাল হয়ে উঠছে রেল লাইনের মতোই। স্ট্রেচারে শুয়েই গুঙিয়ে গুঙিয়ে মেহেরুনকে কাছে ডেকে নিলাম! সে আমার হাত চেপে ধরল। ভীষণ মজবুত ছিল চেপে ধরার স্টাইলটা। মনে হলো এমন বন্ডিং ভীষণই এক্সপেনসিভ এবং রিয়ার।
-বললাম, তোমার কিছু হয়নি তো মেহেরুন?
-না!
খুবই মৃদু ও অস্পষ্ট অ্যানসার! আর তেমন কিছু বলতে পারল না সে! কণ্ঠ ভারি হয়ে এলো ওর। নরমাল কিছুতে তো মেহেরুন অমন মুষড়ে পড়ে না!
-কী হলো, তুমি ঠিক আছ তো?
-জি, ঠিক আছি!
-তবে এমন আনপ্রেডিকটেবলভাবে কথা বলছ কেন? এত নিস্তব্ধ আর শুষ্ক কেন কথাগুলো?
-এমনি!
-এমনি? এতটা নিরস তো হয় না তোমার উচ্চারিত শব্দগুলো!
-সময়ই কখনো কখনো মানুষকে নিরস-নিস্তব্ধ-নিঃসঙ্গ এবং একাকী করে তোলে সীমান্ত।
-নট ইজি টু ছে? হোয়াট হ্যাপেন্ড টু মি?
-অ্যাক্সিডেন্ট!
-অ্যাক্সিডেন্ট? কখন? কিভাবে? কোথায়? নিউজটা আমার নিউরনকে খামচে ধরল। শরীরে অ্যাক্সিডেন্টের কোনো রকম সেন্টিমেন্ট নেই কেন?
-মেহেরুন বলল, ব্যাংক কলোনি রোডে! আমি বাইক থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে মেজর কোনো ইনজুরি হয়নি! সামান্য আঘাত পেয়েছি পায়ে। দ্যাটস কল মিরাকেল! তবে ব্যথা আছে। এক্সরে ফিল্মে বোঝা যাবে ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না?
-এক্সরে করনি এখনো?
-না!আমারইনজুরি ক্রিটিক্যাল নয়। ইভেন, ইয়োর ওন্ডস আর ফায়ার্সলি ডেডলি।
-হোয়াই ডন্ট ইউ ছে সামথিং ইন ডিটেল?
-প্রোপার ট্রিটমেন্টের জন্য তোমার ব্রেনের এমআরআই স্ক্যান করাটা ইমারজেন্সি খুব। এমআরআই রিপোর্ট ছাড়া ব্রেনের মতো সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে কথা কলতে চাচ্ছেন না ম্যাক্সিমাম অনডিউটি জুনিয়র কনসালটেন্ট! ষাট কিলো স্পিডের বাইকটা ইলেকট্রিসিটির পিলারের সঙ্গে জোরসে ধাক্কা লেগেছিল। সেফটি গিয়ারগুলোও আনফিট হয়ে পড়েছিল মুহূর্তেই। সাইলেন্সারের গোঁ গোঁ শব্দে আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোর কার্নিসে বসে থাকা পেন্ডামিক কাকদের কা কা আওয়াজে আনবিয়ারঅ্যাবল যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল আমার মাথা-নাক মুখ-চোখে। ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় চোখ জ¦লতে শুরু করে দিয়েছিল। কী রকম এক বীভৎস সময় গিলে ধরেছিল আমাদের! হেলমেট তোমার মাথাটাকে আংশিক সেভ করেছে। নিজের অস্তিত্বকে সঁপে দিয়েছে হেলমেটটা! নিজে থেঁতো হয়েও সমুজ্জ্বল রেখেছে অন্য আরেকটা জীবন। যে জীবন আরও বেশ কটা জীবনের শেষ নিঃশ^াসের নির্ভরতা! কী যে হতো আজ?
-কী হতো? মৃত্যু? ডেথ ইজ দ্য মোস্ট রিয়েল চ্যাপ্টার অব লাইফ।
-ডু নট ছে সো!
-মৃত্যু তো বিধান মেহেরুন, জীবনের বাস্তব উপসংহার! মৃত্যুই তো জীবনের স্বাদগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে। মৃতুর ইউনিট বাদ দিয়ে কি জীবনকে গল্পের পাণ্ডুলিপি ভাবাযায় কখনো? এত কিছু ম্যানেজ করলে কিভাবে?
-হাসপাতালে ফোন করেছিলাম। ওরা আমার এমন মুমূর্ষু পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্স অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছিল!
-এতসব ঘটে গেছে? তারপরেও আই অ্যামস্টিল ইন সেন্স। কিন্তু ক্লিলিয়ারলি সবকিছু মনে পড়ছে না কেন মেহেরুন?
-এটা টেম্পরারি ডিমেনসিয়া! প্রেসক্রাইবড ধরে ট্রিটমেন্ট শুরু করলেই প্রোপারলি আগের অবস্থায় ফিরে আসে সবকিছু।
-হপিং ফর সামথিং লাইক দ্যাট।
-হোয়াই নট? ইউ আর কোয়াইট নাউ। ডক্টরস আর গিভিং ইয়োর ইনিসিয়াল ট্রিটমেন্ট।
আমি চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এ কী, দুটো চোখই জমাট বাঁধা রক্তের দু-তিন ইঞ্চি নিচে! তবে কি আমার চোখ দুটো আর কখনো জীবিত হয়ে উঠবে না? আঁৎকে উঠলাম। ডাক্তররা নরমাল স্যাভলন দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করছে, কপালের ঝুলেপড়া চামড়া কাঁচি দিয়ে কেটে তুলো ও প্রোটেক্টেড নরম কাপড় পেঁচিয়ে দিয়েছে। ব্যান্ডেজ করতে গিয়ে রক্ত একটু বেশিই ঝরেছে। তারপরেও বিন্দু পরিমাণ পেইন ফিল হয়নি কেন জানি! তবে কি ডাক্তাররা লিডোকাইন ইঞ্জেকশন পুশ করেছিল? চামড়া ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছিল কখন, সেটাও বুঝতে পারিনি! পেইন কন্ট্রোলে রাখতে আপাতত ইনজেকশনের কম্বাইন্ড ডোজ দিয়ে ইমারজেন্সি থেকে কেবিনে শিফট করল আমাকে। এভাবে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করব, কে জানত? কপালে ব্যান্ডেজের কারণে চোখের ভগ্নাংশে ভিড় করেছে কৃত্রিম অন্ধকার, চাপচাপ বিষণ্ন অন্ধকার। এমন অন্ধকারে হৃদয় যদি কেঁপে ওঠে, উঠুক! এই অন্ধকারে ঢেকে গেছে জীবনের গতিপথ। স্পষ্টভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মেহেরুন মাথার চুলগুলো নাড়িয়ে দিচ্ছে, আমার দিকে সংবেদনশীল এক অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন অবাক হয়ে দেখছে! ওর ওই চাহনিজুড়ে আমি বিষণ্নতার আলামত খুঁজে পেলাম। কী এমন হয়েছে আমার? শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে রিসেন্টলি তা ফিল হয় না। দ্যাটস হোয়াই আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড অ্যানিথিং? সো হোয়াট অ্যাম আই সেভেরেলি ওন্ড?
-মেহেরুন বলল, কেমন লাগছে এখন?
ওর এমন প্রশ্নে অবাক হইনি। মেয়েরা মাঝে মাঝে উপেক্ষিত এক জীবনের ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে যায়, নিজের রেফারেন্স বলতে ওরা কেবল স্ট্রং একটা আইডেন্টিটি খোঁজে। হয়তো আমি তেমনি একটা ব্ল্যাকহোল কিংবা আইডেন্টিটি ওর লাইফে! তাই কি? তা না হলে নিজের ইনজুরির দিকে খেয়াল না করে আমাকে নিয়ে অত টেন্সড হবে কেন? কেনই বা মুখটা শুকিয়ে ফেলবে?
-বললাম, ভালো! তবে সত্যিই ভালো আছি কি না- জানি না! আমি কোথায় মেহেরুন?
-হাসপাতালে!
-তোমার?
-জি!
-এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল?
-জি!
মেহেরুনের কলিগ (এরপর ১১ পৃষ্ঠায়)
নার্সরা মেডিকেল ইকুইপমেন্টসমেত এগিয়ে এলো। সেনট্রালাইজ মনিটর, নিউম্যাটিক স্যুট, ড্রাগের রেফারেন্স, প্রোটেবল মনিটর, সিরিঞ্জ পাম্প- এত ইন্সট্রুমেন্ট এত তাড়াতাড়ি কীভাবে অ্যারেঞ্জ করল তারা? তাদের হসপিটালিটি অন্য পেসেন্টদের ক্ষেত্রেও কি এমনই?
-বললাম, এত অস্থির কেন লাগছে মেহেরুন?
-ত্বকের মেজর কোষগুলোর ক্রিয়েটিভিটি নিস্তেজ হয়ে আসছে তো, তাই!
-তাহলে কি আমি আর বাঁচব না?
-হোয়াট আর ইউ সেয়িং সীমান্ত? ইটস জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট! ইউ উইল বি অ্যাজ হেলদি অ্যাজ বিফোর।
-রিয়েলি?
-জি! হোয়াই ডু ইউ থিং সো ইন অ্যাডভান্স? তুমি কি সেন্সে নেই?
-ক্লিয়ারলি বলতে পারছি না! তাই তো, আমি কি সেন্সে নেই? মেহেরুনকে তো প্রতিদিনই হাসপাতালের এন্ট্রি গেটে ড্রপ করতে আসি! বাইকে করে এভাবেই তো নামিয়ে দিতে আসতে হয় ওকে! আজও তো রুটিনের ব্যতিক্রম হয়নি! আসার সময় ব্যাংক কলোনি রোডের ডিভাইডারটা কি আজ চোখে পড়েনি? অ্যাক্সিডেন্ট করলাম, ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে গিয়ে বাইকটা ইলেকট্রিসিটির পিলারের ওপর আছড়ে পড়ল- এসব কি আমার সত্যিই মনে নেই? জ্যামের কারণে প্রতিদিন ওকে পৌঁছে দিয়ে আমিও অফিসে যাই! তাহলে কি আমার মাথার ইনজুরিটা ভীষণই ক্রিটিক্যাল? পিউ কোথায় মেহেরুন?
-বাসায়!
-সুলগ্নার কাছে?
-জি! সে ছাড়া আর কেই বা ওকে টেক-কেয়ার করে? আমি ডিউটিতে আর তুমি অফিসে গেলে তো পিউয়ের সবকিছু সুলগ্নাই সামলে নেয়। রিয়েলি ইউ কান্ট রিমেমবার অ্যানিথিং?
-জানি না! বাট আই ডন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড অ্যানিথিং! মেয়েটা যে কী করছে?
-অত ভাবছ কেন? সুলগ্না আছে তো! পিউ সুলগ্নাকে পেলে আর কিছুই মনে রাখে না!
-ঠিকই বলেছ। কী বন্ডিং ওদের!সুলগ্না যেন পিউয়ের জীবনের জন্য একটা গ্রাফিক প্রোফাইল, একটা ঐতিহাসিক প্রতিবেদন, যেন আমৃত্যুর জলতরঙ্গের ছায়া!
পা দুটো সটান মেলে দিলাম। কষ্ট হলো! এত ভারি কেন দুটো পা? ভেঙে ভেঙে আসতে লাগল সবকিছু। স্টেথিসকোপ কাঁধে ডাক্তাররা এ-বেড থেকে সে-বেড ঘুরছে, রিপোর্ট চেক করছে, পেসেন্টদের নার্ভ দেখছে, প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিচ্ছে। সবারই বাঁচার কী আকুতি! জীবনটাকে মানুষ এত ভালোবাসে কেন? মেহেরুনকে বললাম, মাথার এমআরআই স্ক্যান কখন হবে?
-ইলেকট্রিসিটি নেই। লোডশেডিং চলছে শহরে।
-জেনারেটর?
-জেনারেটরের লুব্রিকেসন সিস্টেম ড্যামেজ।
-তাহলে কি আজ স্ক্যানিং হবে না?
-এভাবে কেন ভাবছ? ডন্ট বি আনস্ট্যাবল। অব কোর্স অলটারনেটিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট!
-এত টেন্সড হতাম না, যদি না মাথা হতো!
এক্সপেনসিভ সব টেস্ট। ল্যাব-কাউন্টার-ডিসপেনসারি সবকিছু একাই সামলাচ্ছে মেহেরুন। ওর কলিগ নার্সরা হেল্প করছিল ওকে। নার্সের হাজব্যান্ড হিসেবে স্টাফরা আমার একটু এক্সট্রা কেয়ারই করছিল। তারপরেও এসব থেকে আমি দূরত্ব খুঁজছিলাম, যোজন যোজন দূরত্ব! মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছিল, কিটকিট করছিল মন ও মগজ। মাথার একপাশে পেইন হচ্ছিল খুব। ইনজেকশনের ডোজে এতক্ষণে কিছুটা তো ইমপ্রুভ হওয়ার কথা! দুর্বল হয়ে উঠছি, ঘোলা দেখছি, ভেতরে ভেতরে শরীরটা কাঁপছেও। অতিরিক্ত টেনশন হলে আমি এরকমই ফিল করি! সিনিয়র এবং স্পেশালিস্ট একজন ডাক্তার নিয়ে এলো মেহেরুন।
-বলল, হি ইজ মাই হাজব্যান্ড স্যার। ইফ ইউ স অ্যা লিটল, আই উড বি গ্রেটফুল!
-হি ডিড নট টেল ইয়োর হাজব্যান্ড, হোয়াই নট বিফোর?
পরিচয় পেয়ে আমার প্রতি ডক্টরের অবজারভিটি বেড়ে গেল। তিনি আমার পালস রেট দেখলেন, মাথার ইনজুরিও চেক করলেন। কিন্তু জুনিয়র কনসালটেন্টদের মতোই তিনিও বললেন, এমআরআই স্ক্যান ছাড়া মাথার ট্রিটমেন্ট এখন সম্ভব নয়। তাছাড়া মেজর কোনো ইনজুরি তো মনে হচ্ছে না! ডন্ট অরি, ফাইনাল রিপোর্ট এলে আমরা ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। এখন আপনি পেসেন্টকে একটু নিঃশব্দে থাকার স্পেস দিন। তিনি যেন ঘুমানোর ট্রাই করেন!
-মেহেরুন বলল, ঠিক আছে স্যার। ব্যাপারটা আমি হ্যান্ডেল করছি।
-আপনি এই বেডেই আজ ডিউটি করুন মেহেরুন। আপনাকে ভেতর থেকে ভীষণ স্ট্রং মনে হচ্ছে। আপনার হাজব্যান্ডের এমন কন্ডিশনেও মনকে শক্ত রেখে সবকিছু একাই সামলে নিচ্ছেন। ইটস রিয়েলি কমপ্লিমেন্ট। তাছাড়া নার্সরা তো অনেকটা ডাক্তারেরই অংশ।
-নার্সেস আর হ্যাপি টু হ্যাভ ইয়োর কমেন্টস অ্যাবাউট স্যার।
-বেস্ট উইশেস ফর ইয়োর হাজব্যান্ড। হি ইজ হিলড আর্লি।
ডক্টর চলে গেলে শুয়ে পড়লাম। আবার একটা ইনজেকশন পুশ করল মেহেরুন। কীসের এত ইনজেকশন? একসময় ইনজেকশনফোবিয়া ছিল আমার। মেহেরুনকে বললাম, ইনজেকশন না দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিলেও তো হয়! তা না হলে ঘুমের ওষুধ দাও। খেয়ে ঘুমিয়ে যাই!
-এটা তোমার ফার্স্ট এইড চলছে। আসল ট্রিটমেন্ট শুরু হবে রিপোর্ট আসার পর।
-আবার ফার্স্ট এইড? তাহলে ইমারজেন্সিতে আউটডোর ডক্টররা কী করল?
মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে কাচের টুকরোগুলো সেধিয়ে গেছে! হেলমেটের কাচ? হবে হয়তো! যেভাবে মেহেরুন বলল- তাতে মাথায় হেলমেট না পরলে নিশ্চিত ইলেকট্রিসিটির পিলারের সাথেই মাথার বাকি অংশ লেপ্টে থেকে যেত কুকুর শকুনের একবেলার ফুড মেনু হিসাবে! ব্যান্ডেজের ভেতরে অ্যান্টিসেপটিকগুলো শুকিয়ে গেছে মনে হ্েচ্ছ। তা না হলে এমন খসখস করবে কেন? তাহলে কি ব্যান্ডেজের নিচে কোনো কাচের টুকরো ছাড়া পড়েছে? রক্তগুলো কি এত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে উঠেছে? রক্ত ঝরলেই বুঝি শুকিয়ে যায়? কালচে হয়? চোখ বুজে আসতে লাগল আমার। রক্তচাপও বাড়ছে বোধ হয়! মুহূর্তেই সবকিছু ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠতে থাকল। মাংসের কোষগুলোও নিস্তেজ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। ব্যান্ডেজের ফাঁক গলিয়ে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করছি খুব। অস্থির উচাটন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি এভাবে জীবনের সমীকরণ মিল করা যায়? অগুনতি টেস্ট দেবে ডক্টররা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে একটা রোগ নির্ণয়ের জন্য কমপক্ষে চার পাঁচটা টেস্ট প্রেসক্রাইবড করতে দেখেছি ডাক্তারদের। আমিও তো তার ব্যতিক্রম নই নিশ্চয়ই? প্রেসার লিপিড, অ্যাটমিক অ্যানার্জিতে পেচ্ছাব টেস্ট, ব্লাডে সুগারের পরিমাণ নির্ণয়, ব্রেনের এমআরআই স্ক্যানিং- এতসব মেহেরুনকে একাই হ্যান্ডেল করতে হবে।
-ওকে বললাম, সুলগ্নাকে ফোন করে আসতে বল। একা সব সামলাতে গিয়ে টায়ার্ড হয়ে পড়বে।
-এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! বাসায় ফোন করলে সবাই অস্থির হয়ে উঠবে। শহরে এখন পলিটিক্যাল এক্সসাইটমেন্ট চলছে। এমন পলিটিক্যাল পেন্ডামিকে রাস্তায় বের হওয়াটাও রিস্ক। তাছাড়া আমার কলিগরা হেল্পফুল। শুরু থেকেই সার্বক্ষণিক ওরা আমাদের সঙ্গে আছে- দেখছ না?
-জি, তা তো দেখছিই! ওনাদের অন্য ওয়ার্ডে ডিউটি আছে না?
-আছে। তবে কলিগরা রিলেটিভদের ক্ষেত্রে সিনসিয়ারলি গ্রেটফুল। লিভ ইট আপ টু মি দ্য হোল থিং অব ইয়োর ট্রিটমেন্ট।
-তারপরেও তুমি বাসায় ফোন কর।
-করব?
-কর!
সুলগ্নার কাছে ফোন করল মেহেরুন।
-ভাবি?
-হ্যাঁ! তুমি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে?
-কী হয়েছে ভাবি?
-অবজারভেটিভ ইনজুরি।
-কার?
-আমাদের।
-সিরিয়াস কিছু হয়নি তো ভাবি?
-সীমান্তর ব্রেনের এমআরআই স্ক্যান করাতে হবে। পিউকে রেখে এসো।
-আসছি!
একটা যন্ত্রণার অনুশোচনা খামচে ধরল সুলগ্নার হৃদয় ও দেহকে। দুঃশ্চিন্তার দৈত্য ওকে গ্রাস করতে থাকল। মস্তিষ্ক হতে থাকল অসাড়, দুঃসহ এবং অপ্রাসঙ্গিক। সুলগ্নাও বোধ হয় ভেতর থেকে ভেঙে ভেঙে পড়ছিল।
মেহেরুনের কলিগরা আমার জন্য কেন এত কষ্ট করছে? তাছাড়া মানুষ কি অন্যের জন্য কখনো কষ্ট করে? নাকি অন্যের জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করে নিজের জন্যই কষ্ট করে? এক গবেষণায় এটাকে ‘মিরর নিউরন ইফেক্ট’ বলা হয়েছে। আমিও বোধ হয় নিজের জন্যই কষ্ট পাচ্ছি খুব! আজ থেকে আমিও কষ্টের কাস্টমার হয়ে গেলাম। রুটিনমাফিক ওষুধের সঙ্গে গলাগলি সত্যিই নতুন এক্সপেরিয়েন্স জীবনের জন্য। ওষুধ সেবনের পার্মানেন্ট কাস্টমার হয়ে আমাকে হয়তো এভাবেই অনেক দিন বেড রেস্টে থাকতে হবে! অ্যানেসথেসিয়া নিলে কেমন হয়? তাতে আর কিছু না হোক- সেন্সলেস হয়ে ঘুমাতে তো পারব! মেহেরুন আমার পাশে এসে বসল। ইলেকট্রিসিটি তখনো আসেনি। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে হাসপাতালগুলো দিনের বেলাতেও অদ্ভূত রকমের খা খা করে ওঠে। এমনি এক আনকমফরটেবল পরিবেশের সাথে মিশে যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে আমাদের।
-বলল, একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। ঘুমালে মেডিসিন শরীরের শিরা উপশিরায় খুব দ্রুত পৌঁছায়। এতে কোষগুলো ধীরে ধীরে কার্যক্ষম হতে শুরু করে। হাই ডোজের ব্যথার ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। না ঘুমালে ক্ষতস্থানে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক হবে না, শুকাতেও সময় নেবে। স্লিপ ইজ দ্য বেস্ট সিস্টেম অব অল ইলনেস।
-আমাকে অ্যানেসথেসিয়া দাও।
-অ্যানেসথেসিয়ার প্রয়োজন হলে তো সিনিয়র স্পেশালিস্ট ডক্টরই সাজেস্ট করতেন। তিনিও এমআরআই স্ক্যান ছাড়া কিছুই বলে গেলেন না, দেখলে না?
-তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক দাও!
-ইট ডাজেন্ট ইভেন নিড ইট! ডন্ট মুভ ঠু মাচ। ইফ দ্য স্টিচেস আর টর্ন, দ্য ইনফেকশন ক্যান অকার।
-ইনফেকশন হলেই বা ক্ষতি কী, যেখানে কপালের চামড়া ছিঁড়ে ঝুলে এসেছে!
হাসপাতালের ওয়েটিং রুম কিংবা ইমারজেন্সিতে আমার মতো কত কত পেসেন্ট! সর্বস্ব দিয়েও জীবনকে চিরকাল সুস্থ রাখার যে মহড়া- তা যেন জেনেটিক ধারার বহির্প্রকাশ! অধ্যাপক আনোয়ার পাশা তো বলেছেনই, মানুষের সবকিছু শেষ হলেও বাঁচার ইচ্ছেটা কারও শেষ হয় না! আমারও কি তাহলে বাঁচার ইচ্ছেটা এখনো দৃঢ়? ভীষণভাবে দৃঢ়? তবে কি আমিও জীবনের অনুভূতিতে নিজস্ব সত্তাকে বিলিয়ে দিয়েছি? আর বিলিয়ে দেওয়াটায় বা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমার বিপন্ন মুখ আর পাণ্ডুর দৃষ্টিজুড়ে এখন কেবলই বাড়তি সেন্টিমেন্ট! কান পাতলেই শুনতে পাই যেন দুঃসময়ের খুতবা! আবার ডক্টর এলো। জুনিয়র কনসালটেন্ট তিনি।
-বলল, ব্রেনের এমআরআই স্ক্যান হয়েছে?
-মেহেরুন বলল, জি না স্যার। ইলেকট্রিসিটি নেই।
-যেভাবেই পারেন রিপোর্টটা করিয়ে নিন। ট্রিটমেন্ট শুরু করতে না পারলে সিরিয়াস কিছুও হতে পারে। আপনার পেসেন্টর বর্তমান কন্ডিশন কী মেহেরুন?
-স্ট্যাবল স্যার। সেন্সেই আছে এখনো।
-ইটস ভেরি গুড সাইন। তবে এখানে এমআরআই স্ক্যান করানো না গেলে অন্য কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করিয়ে আনুন কুইকলি।
মেহেরুনকে টেন্সড লাগছে। যথারীতি ডায়াগনিসিস, স্লিপের পর স্লিপ সাবমিট, কাউন্টার থেকে রিপোর্টিং ফাইল কালেক্ট- ইটস রিয়েলি আনবিয়ারঅ্যাবল ফর অ্যা উইম্যান। আমার কিছুই ভাল্লাগছে না! লাশের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে শরীর। একটু তেরচা হয়ে শুয়ে পড়লাম। ব্যান্ডেজ করার পর জোর করেই চোখ মেলার চেষ্টা করছিলাম, কথাও বলছিলাম সক্ষমতার লিমিট ক্রস করেই। অ্যানার্জি লস হলে ইমোশনও ব্রেক হয়ে যায়। চোখের ঠিক ওপর দিয়ে কপালের একাংশের চামড়া খুলে পড়তে চেয়েছিল। চেয়েছিল? নাকি খুলে পড়েই গিয়েছিল? বাট দেয়ার ইজ নো ওয়ার্ডস, কিপ গড হু কিলস! আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকই! মেহেরুনও টোটালি সাইলেন্ট। স্রেফ অ্যাসটোনিস্ড যাকে বলে। কী যেন ভাবছে সে গভীরভাবে!
-বললাম, তোমার পায়ের এক্সরেটা করিয়ে নাও। ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না- জানা যাবে।
-এই মুহূর্তে আমি আমার ইনজুরি নিয়ে ভাবছি না। আই অ্যাম মোর অরিড আব্যাউট ইয়োর ইনজুরি। দ্য ম্যাটার অব দ্য হেড ইজ ভেরি সেন্সিটিভ।
-একটু রেস্ট নাও। আমার পাশে এসে শোও। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছ তুমি।
মারকুটো দৃষ্টিতে মেহেরুন আমার দিকে তাকাল। ওর সেই তাকানোয় শাসনভিত্তিক দীর্ঘশ^াসের আওয়াজ টের পেলাম। অর্থাৎ আমি ওকে নিয়ে এত ভাবছি কেন? তাহলে কে ভাববে? আমি ছাড়া অন্য কারও এত চিন্তিত হওয়ার কথা কি?
-বলল, তুমি মানসিকভাবে খুবই স্ট্যাবল। এমন সেন্সিটিভ ইনজুরির কত পেসেন্ট দেখেছি! তারা স্ট্রং থাকা তো দূরের কথা, সেন্স ফিরতেও কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
-রিয়েলি?
-জি!
আয়ু যদি বেচাকেনা হতো কোনো ভ্যারাইটি স্টোর কিংবা শপিংমলে- তবে আয়ুই কিনতাম! আয়ু কেনার জন্য ব্যাংকের চেক ভাঙাতাম, প্রোপারটি নিলামে তুলতাম, উদ্বাস্তু হয়ে ব্রহ্মচারি হতাম- তবু আয়ু কিনতাম! তাই কি হয় কখনো? হয় না, হয়ওনি কোনো দিন! এই শহরের আজ কী হয়েছে? আমার ব্রেনের এমআরআই স্ক্যানের জন্য হলেও শহরের বুকে ইলেকট্রিসিটি আসুক! এই শহরের ওপর কীসের এত অভিমান ইলেকট্রিসিটির?
এম মনজুরুল ইসলাম
প্যানেল