ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

আমার এ দুটি চোখ, পাথর তো নয়; তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়...?

শরিফুল রোমান, মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:০৮, ৮ মে ২০২৫

আমার এ দুটি চোখ, পাথর তো নয়; তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়...?

ছবিঃ প্রতিবেদক

আমার এ দুটি চোখ, পাথর তো নয়; তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়...? কালজয়ী স্মরণীয় গানটির কণ্ঠশিল্পী বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় সুবীর নন্দী। সুবীর নন্দী ছিলেন একজন উঁচু মানের বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী। চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করেন। তাছাড়া বেসামরিক অন্যতম পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন সুবীর নন্দী।

তিনি মহানায়ক (১৯৮৪), শুভদা (১৯৮৬), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪) ও মহুয়া সুন্দরী (২০১৫) চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠ দিয়ে পাঁচবার এই পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে নন্দীর গাওয়া উল্লেখযোগ্য গান হলো- দিন যায় কথা থাকে, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে। এছাড়া তুমি এমনই জাল পেতেছ, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো, পাহাড়ের কান্না দেখে, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, একটা ছিল সোনার কন্যা, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে।

তার প্রকাশিত প্রথম গানের অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’। তার অন্যান্য অ্যালবামগুলো হল ‘প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘ভালোবাসা কখনো মরে না’, ‘সুরের ভুবনে’, ‘গানের সুরে আমায় পাবে’ প্রকাশিত হয় এবং ভক্তিমূলক প্রণামাঞ্জলী।

সুবীর নন্দীর ডাক নাম বাচ্চু। সুবীর নন্দী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দী পাড়া নামক মহল্লায় এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত পরিবারে ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মামার বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাদেআলিশা গ্রামে। তার পিতা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীতপ্রেমী। তার মা পুতুল রানীও গান গাইতেন কিন্তু রেডিও বা পেশদারিত্বে আসেননি।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ভাই-বোনদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। তবে সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। বাবার চাকরি সূত্রে তার শৈশবকাল চা বাগানেই কেটেছে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত চাবাগানেই ছিলেন। চা বাগানে খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি বিদ্যালয় ছিল, সেখানেই পড়াশোনা করেন। তবে পড়াশোনার অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছে হবিগঞ্জ শহরে।

হবিগঞ্জ শহরে তাদের একটি বাড়ি ছিল, সেখানে ছিলেন। পড়েছেন হবিগঞ্জ গভঃ হাই স্কুলে। তারপর হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুবীর নন্দী দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকে চাকরি করেছেন।

১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকে তিনি গান করতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ। সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিং এর মধ্য দিয়ে। প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ -এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম।

৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত সূর্যগ্রহণ চলচ্চিত্রে। ১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের ঠোঁটে তার গাওয়া ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম সুবীর নন্দীর গান ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। এছাড়া তার প্রেম বলে কিছু নেই, ভালোবাসা কখনো মরে না, সুরের ভুবনে, গানের সুরে আমায় পাবে (২০১৫) প্রকাশিত হয় এবং প্রণামাঞ্জলী নামে একটি ভক্তিমূলক গানের অ্যালবামও প্রকাশিত হয়।

সুবীর নন্দী জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঃশিল্পকলায় একুশে পদক (২০১৯)। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৮৪: শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী - মহানায়ক, ১৯৮৬: শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী - শুভদা, ১৯৯৯: শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী - শ্রাবণ মেঘের দিন। আরও পেয়েছেন, ২০০৪: শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী - মেঘের পরে মেঘ,২০১৫: শ্রেষ্ঠ পুরুষ কন্ঠশিল্পী - মহুয়া সুন্দরী। বাচসাস পুরস্কারঃ- ১৯৭৭: সেরা পুরুষ কন্ঠশিল্পী, ১৯৮৫: সেরা পুরুষ কন্ঠশিল্পী - শুভরাত্রি, ১৯৮৬: সেরা পুরুষ কন্ঠশিল্পী - শুভদা ইত্যাদি।

সুবীর নন্দী দীর্ঘদিন ফুসফুস, কিডনি ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ১৪ই এপ্রিল তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ৩০ এপ্রিল তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ৫ ও ৬ মে পরপর দুইদিন হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি ২০১৯ সালের ৭ মে ৬৫ বছর বয়সে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

আরশি

×