ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

স্মার্টফোন আসক্তি, প্রজন্মের নীরব ঘাতক

নয়ন আসাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গাজীপুর

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৯ জুন ২০২৫; আপডেট: ১০:৩৮, ২৯ জুন ২০২৫

স্মার্টফোন আসক্তি,  প্রজন্মের নীরব ঘাতক

ছবি: সংগৃহীত

স্মার্টফোন, আধুনিক প্রযুক্তির এক অসাধারণ উদ্ভাবন, যা আমাদের জীবনকে করেছে সহজ এবং গতিশীল। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন মিলে হাতের মুঠোয় এখন পুরো বিশ্ব। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছিলেন, “বিশ্বজগত দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে। কিন্তু এই আশীর্বাদই একটি প্রজন্মের জন্য বয়ে আনছে এক নীরব বিপর্যয়- তৈরি করেছে গুরুতর স্মার্টফোন আসক্তি। এই আসক্তি এখন আর কেবল একটি অভ্যাস নয়, এটি একটি গুরুতর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নষ্ট করে দিচ্ছে জীবনের মূল্যবান সময়।


স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণদের পড়াশোনা, সামাজিক সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একদিকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে ক্রমশই বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন ভার্চুয়াল জগতে ডুবে যাচ্ছে যেখানটা নিয়ন্ত্রন করছে ডিজিটাল কোম্পানীগুলোর জটিল অ্যলগারিদম। এর ফলস্বরূপ বাড়ছে হতাশা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং বিভিন্ন সামাজিক ফোবিয়ার মতো জটিল ও বহুবিধ সমস্যা।

অ্যালগরিদম কিভাবে আসক্তি তৈরি করছে?
স্মার্টফোনে বিশেষকরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ্লিকেশনের ডিজাইন এবং এর পেছনের অ্যালগরিদমগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখতে পারে। যার অ্যালগারিদম যত বেশি মানুষকে তার মনস্তত্ব বুঝতে পারছে, যত বেশি ব্যক্তিগত ডাটাকে কাজে লাগাতে পারছে ততটাই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সহসা। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত একটি কৌশল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর পছন্দ, অনুসন্ধান এবং কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে যুৎসই কন্টেন্টই পরিবেশন করে। আপনি যে ধরনের ভিডিও বা পোস্ট দেখতে পছন্দ করেন, অ্যালগরিদম আপনাকে সেই ধরনের কন্টেন্টই বারবার দেখায়, যা আপনাকে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে উৎসাহিত করে কারনে বা অকারনে।


এছাড়াও, অ্যাপগুলো ক্রমাগত নোটিফিকেশন পাঠিয়ে ব্যবহারকারীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। একটি লাইক, একটি কমেন্ট বা একটি শেয়ার – এই ক্ষুদ্র “পুরস্কার” গুলো আমাদের মস্তিষ্কে ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে। বলতে গেলে মস্তিস্কে ডোপামিন নিঃসরণ করে, যা এক ধরনের তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয়। এই আনন্দের পুনরাবৃত্তি পেতে আমরা বারবার ফোন চেক করি। এই ধরনের অ্যাপে শেষ বলে কিছু নেই, আপনি যত স্ক্রল করতেই থাকবেন এবং নতুন কন্টেন্ট আসতেই থাকবে। একটি আরেকটির চেয়ে হয়তো আরও বেশি আকর্ষণীয়!


এর ফলে ব্যবহারকারীর বিরতি নেওয়ার সুযোগ কমে যায় এবং তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করে সময় কাটিয়ে দেয়। ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্মে একটি ভিডিও শেষ হওয়ার সাথে সাথেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরের ভিডিও চলতে শুরু করে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা ব্যবহারকারীর মধ্যে একটি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বা "কিছু হারানোর ভয়" বা নতুন আপডেটের তাড়না তৈরি করে। যেমন যদি আপনি ফোন থেকে দূরে থাকেন, তাহলে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ আপডেট বা সামাজিক ঘটনা থেকে বঞ্চিত হবেন, এই ভয় বা তাড়না ব্যবহারকারীকে বারবার ফোন হাতে নিতে বাধ্য করে।
লাভ হচ্ছে কার?


স্মার্টফোন আসক্তি থেকে মূলত লাভবান হচ্ছে বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থাগুলো এবং তাদের সাথে জড়িত বিজ্ঞাপনদাতারা। ব্যবহারকারীরা যত বেশি সময় প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করবে, তত বেশি বিজ্ঞাপন তাদের কাছে পৌঁছাবে, আর ততই বাড়বে তাদের আয়। ব্যবহারকারীর ডেটা বিশ্লেষণ করে তাদের পছন্দের কন্টেন্ট ও পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, যা এই সংস্থাগুলোর ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করে। সংক্ষেপে, এটি একটি বিশাল অঙ্কের অর্থনীতির বিষয়, যেখানে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবান সময়, মনোযোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে পুঁজি করা হচ্ছে।

এই আসক্তি থেকে বের হওয়ার কিছু উপায়
স্মার্টফোন আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা রাতারাতি সম্ভব নয়, তবে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা হলেও সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত একদিন বা দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময় স্মার্টফোন থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকার অভ্যস করা যেতে পারে। এই সময়টুকু পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কাটিয়ে একটি বাস্তব জগতের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা করা যেতে পারে।


অপ্রয়োজনীয় অ্যাপের নোটিফিকেশন বন্ধ করেও কিছুটা দূরত্ব করা যায়, এতে বারবার ফোন দেখার প্রবণতা কমে যাবে। বর্তমানে অনেক ফোনেই স্ক্রিন টাইম ট্র্যাকিং ফিচার রয়েছে, যা আপনাকে কোন অ্যাপে কত সময় ব্যয় করছেন তা জানতে সাহায্য করবে। এটি নিজের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করবে। এটা দেখে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।


প্রতিদিনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে,  আপনি কতক্ষণ ফোন ব্যবহার করবেন এবং এই সময়সীমা মেনে চলার চেষ্টা করুন। ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে ফোন বিছানা থেকে দূরে রাখুন, সকালে উঠেই ফোন হাতে নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। অনেকটাই ভালো সময় কাটবে।


স্মার্টফোনের বাইরে বই পড়া, খেলাধুলা, বেড়ানো বা কোনো সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অনলাইন সম্পর্কের চেয়ে বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে প্রাধান্য দিলে ভার্চুয়াল জগত হয়তো ধীরে ধীরে অনলাইন আসক্তি কমে যেতে পারে।


তবে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এ থেকে বের হয়ে আসার সদিচ্ছা। এটা বুঝতে পারা যে এটি একটি নীরব বিপদ, যা মানুষের মেধা ও সম্ভাবনাকে সীমিত করে দিচ্ছে। এই নীরব বিপর্যয় থেকে বের হয়ে আসতে ব্যক্তিগত সচেতনতা, পারিবারিক সমর্থন এবং সামাজিক উদ্যোগ - প্রয়োজন সবকিছুরই সম্মিলিত উদ্যেগ।

আঁখি

×