
ছবি: প্রতীকী
ভালোবাসা, মমতা কিংবা সহানুভূতির মতো বিশ্বাসও এক ধরনের অনুভূতি। তবে এ অনুভূতি গড়ে উঠতে সময় লাগে, কিন্তু ভাঙতে লাগে একটুখানি সন্দেহ। আজকের পৃথিবীতে বিশ্বাস যেন সবচেয়ে দুর্লভ এক সম্পদ। মানুষ এখন শুধু ভয় পায় ঠকে যাওয়ার। প্রতারণা, মিথ্যা ও ফাঁকা আশ্বাসের এক কষ্টকর বাস্তবতা আমাদের সকলের জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
এক সময় মানুষ প্রতিবেশীর ওপর নির্ভর করত। রাতে বাড়ি না থাকলে চাবি দিয়ে যেত পাশের বাসায়। একজন মা তার শিশুকে খেলার ছলে রেখে দিত পাশের খালার কাছে। বন্ধুরা একে অপরের হয়ে মিথ্যা বলে চাকরি বাঁচাত, স্কুল পালাতে সাহায্য করত, আবার বিপদে হলে এক কাপ চা নিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াত। এখনকার সময়েও বন্ধুত্ব আছে, প্রতিবেশী আছে, কিন্তু সেখানে নেই সেই গভীর নির্ভরতা। সম্পর্কগুলো অনেক বেশি সতর্ক, অনেক বেশি হিসেবি।
এই পরিবর্তনের পেছনে একাধিক কারণ আছে। মানুষ বারবার ঠকেছে। বন্ধুর কাছ থেকে, আত্মীয়ের কাছ থেকে, এমনকি প্রেমিক বা জীবনসঙ্গীর কাছ থেকেও। কেউ বিশ্বাস করে টাকা ধার দিয়েছে, ফেরত পায়নি। কেউ চুপ করে নিজের কষ্ট বলেছে, পরে শুনেছে অন্যদের মুখে তা হাস্যরসে রূপ নিয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা একজন মানুষের মনে এমন একটা দেয়াল তুলে দেয়, যার ভেতর থেকে সে আর কাউকে ঢুকতে দেয় না।
শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়েও বিশ্বাস হারিয়েছে মানুষ। একজন নাগরিক যখন দেখে তার কষ্টের টাকায় গঠিত রাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না, তখন সে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বারবার নির্বাচনের আগে উন্নয়নের কথা বলা হয়, কিন্তু দিনশেষে সে দেখে সেই উন্নয়ন ঢাকায় আটকে থাকে, তার গ্রামের রাস্তাটা আগের মতোই ভাঙা পড়ে থাকে। এক সময় সে আর ভোট দিতেও আগ্রহী হয় না। কারণ, তার কাছে রাজনীতি আর রাষ্ট্র কেবল শীতল ও আত্মকেন্দ্রিক এক কাঠামো— যার মধ্যে মানবিকতা নেই, আছে শুধু হিসেব।
বিশ্বাসভঙ্গের এই সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়। গোটা পৃথিবী আজ এক অদ্ভুত আস্থাহীনতার মধ্যে আছে। এক দেশ আরেক দেশকে বিশ্বাস করে না। বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে, কিন্তু নিজেরাই যুদ্ধের আগুনে তেল ঢালে। জাতিসংঘ বা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বড় বড় কথা বললেও, বাস্তবে তা প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে না। সাধারণ মানুষের মনে আজ এমন এক প্রশ্ন জেগেছে— এই সব সভা-সম্মেলন, চুক্তি ও ঘোষণা কি শুধুই নাটক?
বিশ্বাসহীনতা সবচেয়ে ভয়াবহ আকার নেয় যখন তা মানুষের ভেতরে গেঁথে যায়। তখন সে কাউকে আর ভালো চোখে দেখতে পারে না। সবার মধ্যে খোঁজে এক ধরনের ষড়যন্ত্র, এক ধরনের ফাঁদ। এমনকি যে মানুষটা তার ভালো চায়, তাকেও সে অবিশ্বাস করে বসে। তখন ভালোবাসাও পচে যায়, সম্পর্ক ভেঙে যায়, পরিবারে আসে বিচ্ছেদ, সমাজে আসে হিংসা আর স্বার্থপরতা।
একটা সমাজে যদি আস্থা না থাকে, তাহলে মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। সে ভাবে— যদি সবাই ঠকায়, তাহলে আমিও ঠকিয়ে বাঁচি। তখন ঘুষ খাওয়া মানুষটি নিজের বিবেককে বোঝায়, “আমি তো একা কিছু করছি না, সবাই করছে।” এমনকি শিক্ষক যদি অল্প বেতনে সংসার চালাতে না পারে, তাহলে তিনিও নকলের সুযোগ দেন। ডাক্তার যদি রোগীর বিশ্বাস হারায়, তখন চিকিৎসাও হয়ে ওঠে পণ্য। আস্থা ভাঙার এই চক্র এক সময় পুরো জাতিকেই গ্রাস করে।
মানুষ এখন খুব কষ্টে বিশ্বাস করে। কেউ ভালো ব্যবহার করলেও সন্দেহ হয়— সে নিশ্চয়ই কিছু চাইবে। কেউ হঠাৎ ফোন করলে ভাবি, টাকা ধার চাইবে না তো? এই মনোভাব আমাদের প্রতিনিয়ত আরও একা করে দিচ্ছে। আমরা কথা বলি, কিন্তু শেয়ার করি না। আমরা বন্ধু হই, কিন্তু বিশ্বাস করি না। আমরা ভালোবাসি, কিন্তু নিরাপদ থাকতে দূরত্ব রেখে চলি।
এমন নয় যে বিশ্বাস একেবারে হারিয়ে গেছে। ছোট ছোট কিছু ভালোবাসা, কিছু দায়িত্বশীল মানুষ, কিছু সত্যিকারের সম্পর্ক এখনো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, কোনো এক অচেনা পথচারীর সাহায্য, অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো এক তরুণের গল্প—এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে, মানুষ এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।
তবু পরিবর্তন আনতে হলে আমাদেরকেই প্রথম বিশ্বাস করতে শিখতে হবে। প্রতিশ্রুতি দিলে তা রাখতে হবে, কথা দিলে তা পালন করতে হবে। পরিবারে, অফিসে, বন্ধুত্বে, ভালোবাসায়— সব জায়গায় যদি আমরা একটু বেশি মানবিক হই, একটু বেশি দায়িত্বশীল হই, তবে আবার বিশ্বাস গড়া সম্ভব। বিশ্বাস আবার শুরু হয় খুব ছোট কিছু দিয়ে— একটি নির্ভরতা, একটি সত্য কথা, একটি পাশে থাকা হাত দিয়ে।
বিশ্বাস ভাঙার এই পৃথিবীতে বিশ্বাস গড়ে তোলাটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। যখন সবাই অবিশ্বাসে মগ্ন, তখন সত্য বলা এক ধরনের বিপ্লব। আমাদের প্রয়োজন সেই বিপ্লবই। কারণ, বিশ্বাসই হলো মানবতার শেকড়। এই শেকড় শুকিয়ে গেলে সভ্যতা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.