ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

আলোকবর্তিকা তারেক রহমান: ইতিহাসের বাঁকে নেতৃত্বের আলেখ্য এবং নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

শেখ আহমেদ ফরহাদ

প্রকাশিত: ১৫:২২, ২৯ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৫:২২, ২৯ জুন ২০২৫

আলোকবর্তিকা তারেক রহমান: ইতিহাসের বাঁকে নেতৃত্বের আলেখ্য এবং নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

ছবি: সংগৃহীত

দিন যত যাচ্ছে, ততই যেন আপন জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠছেন জনাব তারেক রহমান। জাতির দুর্দিনের আকাশে নক্ষত্রের মতো প্রজ্বলিত হয়ে তিনি পথ দেখাচ্ছেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে। দেশি-বিদেশি শত্রুর বিছিয়ে দেওয়া কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম পথ আর কালো মেঘের ছায়া ভেদ করে তারেক রহমান হয়ে উঠেছেন জাতীয় আশা, আকাঙ্ক্ষা ও ভরসার প্রতীক।

গত ১৩ জুন ২০২৪, লন্ডনে তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জনাব ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক এবং এই বৈঠক ঘিরে সমগ্র জাতির মধ্যে যে গভীর প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে তারেক রহমান আজ একটি দলের প্রধানের সীমারেখা ছাড়িয়ে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারী হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছেন।

জাতীয় জীবনে ১/১১’র ষড়যন্ত্র ছিল এক বিভীষিকাময় আঘাত, যার অন্যতম প্রধান শিকার ছিলেন তারেক রহমান। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে শেখ হাসিনা বিএনপি, জিয়া পরিবার ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেন। ধীরে ধীরে দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ভেঙে মানুষের বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার হরণ করে তিনি ইতিহাসের নির্লজ্জতম স্বৈরাচারে পরিণত হন।

১/১১ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারেক রহমান কারাগারে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। এক সময় চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে বিলেতে শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ, বেদনার্ত ও নিঃসঙ্গ নির্বাসিত জীবন। এই দেড় দশকের নির্বাসনে তিনি হারিয়েছেন প্রিয় সহোদর আরাফাত রহমান কোকোকে; মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠিয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অসুস্থ মা বেগম খালেদা জিয়াকে। একের পর এক সাজানো মামলা ও ফরমায়েশি রায়ে জিয়া পরিবারকে নিঃশেষের ফ্যাসিবাদী খেলায় মেতে উঠে সরকার। অন্যদিকে প্রতিদিনই গুম, খুন, মামলা আর গণগ্রেফতারের শিকার হন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এই পরিস্থিতে একাকী প্রবাসের প্রতিটি মুহূর্ত কতটা অসহনীয়, কতটা কঠিন ছিল, তা একমাত্র তারেক রহমানই জানেন।

কিন্তু তিনি ভেঙেপড়েননি। পিছপা হননি। দৃঢ় প্রত্যয় ও অটল বিশ্বাস নিয়ে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার এবং নাগরিক অধিকারের পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে মুক্তিকামী সকল মানুষ ও পক্ষের একক নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নির্বাসিত জীবনের প্রতিটি ক্ষণেই তিনি প্রমাণ করেছেন—বাংলাদেশ তাঁর চিন্তা, স্বপ্ন ও কর্মপরিসর থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন নয়।

তারেক রহমান গভীরভাবে বুঝেছিলেন—১/১১ কোনো সাধারণ ষড়যন্ত্র নয়; এর শিকড় বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, বহুস্তর আর বহুজাতিক স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর উপলব্ধি ছিল স্পষ্ট: ১/১১’র  শিকার কেবল বিএনপি নয়, প্রকৃতপক্ষে শিকার ছিল বাংলাদেশ নামের রক্তার্জিত ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব।

এই উপলব্ধি থেকেই তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং একজন রাষ্ট্রচিন্তক ও সংগ্রামী কণ্ঠ হিসেবে উদিত হন। সেখান থেকেই আসে তাঁর ঐতিহাসিক আহ্বান—“টেক ব্যাক বাংলাদেশ”।

এই উদ্দীপ্ত স্লোগান নিছক কোনো প্রচারবাক্য ছিলোনা; এটি ছিল একটি রাষ্ট্র চেতনার সারসংক্ষেপ। রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতি নিয়ে ন্যূনতম ধারণা থাকলেই বোঝা যায়, এই শ্লোগানের মর্মার্থ কতটা গভীর ছিল! তারেক রহমান একটি সর্বময় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন— দিল্লীর তাবেদার জগদ্দল হাসিনাশাহীর হাত থেকে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা মুক্ত করে মূলত আগ্রাসনবাদী শক্তির হিংস্র থাবা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে  নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের মর্যাদা ও স্বকীয় পথচলায় ফিরিয়ে আনার বিপ্লব।

তাঁর বিপ্লবী আহ্বান ও প্রভাব বুঝে স্বৈরাচার সরকার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু তাতেও তিনি দমে যাননি। দেশে অবস্থানরত অকুতোভয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে প্রযুক্তির সহায়তায় সম্ভাব্য সকল উপায়ে তিনি জনতার কাতারে নিজেকে হাজির রেখেছিলেন।

বিপ্লবের ডাক দিয়েই তিনি বসে থাকেননি, প্রতিমুহূর্ত তিনি বিপ্লবকে লালন করেছেন এবং আন্দোলন সংগ্রামের দিক নির্দেশনা দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। সময়ের বাস্তবতায় গুম-খুন আর হামলা-মামলায় জর্জরিত বিপ্লবীদের মনে সাহস ও আশা সঞ্চারের জন্য তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন—“যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।”-

এই একটি উদ্দিপ্ত শ্লোগানেই যেন সংগ্রামী জনতার অন্তরে বেজে উঠেছিল অগ্নিবীণা। দীর্ঘ সতের বছর বাংলাদেশ ঝিমিয়ে যায়নি, প্রতিটি মুহূর্তে তারেক রহমানের নেতৃত্বে জেগেছিল বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে। এভাবে অদম্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশের আপামর জনতা তাঁর নেতৃত্বে একটানা লড়াই চালিয়ে গেছেন। এরই পরিণতিতে আসে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গৌরবময় গণঅভ্যুত্থান ও বিজয়।

৫ আগস্টের পর জাতির সামনে উদিত হলেন এক বিস্ময়কর তারেক রহমান—যিনি প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার নয়, বরং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি। চরম দুঃসময় ও অবিচারের যন্ত্রণার আগুনকে হৃদয়ের গভীরে গলিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন সহনশীল নেতৃত্বের সৌম্য ব্যাকরণ। তিনি আস্থা রাখলেন দেশের বিচারব্যবস্থায়। তিনি ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার ও তার কুশীলবদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাইলেন এবং দেশবাসীকে আইন ও বিচারের সংস্কৃতিতে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন। তাঁর নেতৃত্ব যেন ধ্যানমগ্ন ঋষির ধৈর্য আর বজ্রকঠিন সংকল্পের মিশেল।

৫ আগস্টের অভ্যুত্থানোত্তর জাতি নতুন এক সংকটে নিপতিত হয়। বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রবিরোধী নানামুখী চক্রান্তের মধ্যে জাতি যখন দিশেহারা, তখন আবারও সামনে আসেন তারেক রহমান। এবার তিনি জাতিকে শোনালেন আরও গভীর, আরও পরিশ্রুত এক স্লোগান—“সবার আগে বাংলাদেশ”। এই বার্তার গুরুত্ব শুধু এর শব্দে নয়, এর সময়োপযোগী উপস্থিতি ও সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিহিত। অভ্যুত্থানোত্তর বাস্তবতায়, যেখানে দলীয় বিভাজন, আন্তর্জাতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ হতাশা প্রবল, সেখানে একটি নিরপেক্ষ, সাহসী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্দেশ্য নির্ধারণে এই স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতির নতুন দিকচিহ্ন।

গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে সেটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার। নিকট অতীত সাক্ষী দেয় এই সংস্কারের প্রস্তাব সর্বপ্রথম তারেক রহমানই উচ্চারণ করেছিলেন। ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে জনাব তারেক রহমান জাতির সামনে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত বা সংস্কারের ৩১ দফা কর্মসূচি তুলে ধরেন। তিনি যে ৩১ দফা দিয়েছেন, তা কেবল একটি দলীয় ইশতেহার নয়, বরং একটি রাষ্ট্র সংস্কারের সুস্পষ্ট দলিল ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা; সেখানে যেমন আছে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার, তেমনি আছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। এই কর্মসূচি তাঁর গভীর রাজনৈতিক উপলব্ধি, সংসাকার ভাবনা ও দীর্ঘমেয়াদি ভিশনেরই প্রতিফলন।

লেখাটি শেষ করব সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চমৎকার একটি ঘটনা দিয়ে। লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের প্রাক্কালে জনাব রহমান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সাহেবকে বই ও কলম উপহার দিয়েছেন। এই বই ও কলম উপহারের মাধ্যমে তিনি কী নতুন প্রজন্মের কাছে নিঃশব্দ কোনো বার্তা পাঠিয়েছেন? আমার বিশ্বাস, এই ছোট অথচ গভীর প্রতীকী কর্মকাণ্ডে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে জনাব রহমানের ভবিষ্যৎ ভাবনা। নতুন প্রজন্মের প্রতি তিনি শক্তিমত্তা নয়, জ্ঞানের রাজনীতির দিকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন— আগামী দিনে পেশী নয়, রাজনৈতিক লড়াই হবে জ্ঞান, যুক্তি, নীতি ও বিবেক দিয়ে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, তারেক রহমান পুরোনো ধাঁচের রাজনীতিকে সরিয়ে দিয়ে একটি আধুনিক, দায়িত্বশীল ও জনমুখী বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের, জবাবদিহিতার, উন্নয়নের এবং সহনশীলতার। যেখানে ভিন্নমত থাকবে, থাকবে অংশগ্রহণমূলক নীতি, থাকবে জনগণের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার এবং ভূ-রাজনৈতিক আত্মমর্যাদা। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এই মানসিকতা তারেক রহমানের ভিন্নমুখী নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে। তারেক রহমানের মতো দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নেতাই পারেন এই জাতিকে স্থির লক্ষ্য, সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও সম্মিলিত স্বপ্নের দিকে নিয়ে যেতে। স্বভাবতই ৫৫ হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি বাঁকে জনপরিসরে তারেক রহমানের নেতৃত্বে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে

আবির

×