
নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের এই বাজেট আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে। গত ২ জুন ঘোষিত বাজেটে কী ছিল এবং পরবর্তীতে কী অনুমোদিত হয়েছে, এ নিয়ে জনমনে কৌতূহল থাকারই কথা।
প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, তা বাদ দিয়েছে সরকার এবং একই সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ শুল্ক-করেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকার পরিবর্তে এবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ এতে অন্তর্ভুক্ত নেই।
শুল্ক-করেও পরিবর্তন এসেছে। পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানি যাদের পরিশোধিত মূলধনের অন্যূন ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিও বা সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আয়ের সাড়ে ২২ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সব ধরনের আয় ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২০ শতাংশ হবে। অন্যান্য পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২৭ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সব আয় ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে করহার ২৫ শতাংশ।
এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের করহার ১৫ শতাংশের স্থলে ১০ শতাংশ হবে। সম্পত্তি হস্তান্তর হতে কর কর্তনের হার ৮ শতাংশ, ৬ শতাংশ ও ৪ শতাংশের স্থলে কমিয়ে যথাক্রমে ৫ শতাংশ, ৩ শতাংশ ও ২ শতাংশ করা হয়েছে। রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর সাড়ে ৭ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝুট থেকে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তুলার উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা পরিচালিত বিউটি পার্লারের স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর এবং বলপয়েন্ট কলমের আমদানি পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। হার্টের রিং ও চোখের লেন্স আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঋণপত্রে ভ্যাট এক শতাংশ থেকে .০৫ শতাংশ করা হয়েছে উৎসে কর।
এর ফলে দাম কমতে পারে এমন পণ্যগুলো হলো : ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর ডাল, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, ডাল, ভুট্টা, মোটা আটা, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, খেজুর, ক্যাসিয়া পাতা, কম্পিউটার ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ এবং সব ধরনের ফল। সেক্ষেত্রে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির হবে।
বাজেটে এলএনজি আমদানিতে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে এলএনজির দাম কিছুটা কমবে। ক্রুড ফুয়েল অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে এবং অন্যান্য জ্বালানি আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ কমানো হয়েছে। এ ছাড়া নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর এবং ভূমি নিবন্ধন খরচ কমেছে।
এখন শঙ্কার বিষয়টি হলো বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে, যা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। কারণ, চলতি (২০২৪-২৫) বছরের বাজেট বাস্তবায়ন যেসব কারণে সন্তোষজনক হয়নি, একই অবস্থা ২০২৫-২৬ এর বাজেট বাস্তবায়নেও প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, চলতি বাজেট (যার মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হবে) এবং আগত বাজেটÑ দুটিই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হবে, যা হবে রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজস্ব আহরণ সরকারের ব্যয় মেটানোর একটি বড় কাজ, যা এনবিআর-এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এক সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১১ মাস (জুলাই-মে) শেষে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। তিন খাত মিলিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৮৩.১০ শতাংশ অর্জন করেছে এনবিআর, যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ। এনবিআর জানায়, চলতি অর্থবছরের মে ২৫ মাস পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৪৬০.৪৫ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২.২৬ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮৩.১০ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছে বাজেট বাস্তবায়নে। অর্থবছর শেষ হতে চললেও গতি নেই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। ১১ মাসে খরচের অগ্রগতি মাত্র ৪৯.০৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের চেয়ে এবার উন্নয়নে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচ কম হয়েছে। জুন মাসে খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ মাসে ১ লাখ ১৫ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা খরচের টার্গেট রয়েছে, যা অসম্ভব মনে করছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, অর্থবছরের শেষ মাসে সরকারের যেমন এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তেমনি খরচেরও সামর্থ্য নেই।
প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং বিনিয়োগ স্থবিরতাÑ সব মিলিয়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরটি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৫ শতাংশের নিচে নামতে পারে। আইএমএফের পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮ শতাংশ, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক ৩.৯৭ শতাংশের হিসাব থেকেও কম।
তাদের মতে
১. কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া উত্তরণ কঠিন হবে;
২. রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা;
৩. সরকারি ঋণ নির্ভরতা ও সুদের চাপে বেসরকারি খাত;
৪. মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক সংকট;
৫. বিনিয়োগ-রপ্তানিতে ভাটা, কর্মসংস্থানে প্রভাব ইত্যাদি।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি পরিবহন ব্যাহত হয়, তাহলে জ্বালানি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানি ও শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে জটিলতা তৈরি হলে অনেক প্রবাসী চাকরি হারাতে পারেন। তেল-গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে দেশের শিল্প খাতও নতুন সংকটে পড়বে।
অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সরকারের জন্য বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ হলোÑ এর মধ্যে আছে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনে আয় বাড়ানো, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সঠিক খাতে কার্যকর করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়া। কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, যদিও এসব বিষয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও রাজস্ব খাতের সংস্কার।
সামাজিক সুরক্ষা খাতেও নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেট পাস করা হয়েছে। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে। তাছাড়াও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসেও বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। বরং এ সংকট আরও বেড়েছে, যার ফলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বেড়ে গেছে।
একই সঙ্গে সংকট মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। বিদেশি ঋণের বোঝাও বেড়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে এসব ঋণ পরিশোধ। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। তাই সংকটের দোলাচল থেকে মুক্ত হতে হলে টেকসই গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক
সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা)
প্যানেল