
সার্কুলার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
সার্কুলার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু পরিবেশ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্যই কমাচ্ছে না, আর্থিক উন্নতির নতুন পথ উন্মোচিত করেছে। সেই সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গড়ে উঠা ব্যবসা দেশের ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৮৮ শতাংশ পরিবার ও ভাঙ্গারিওয়ালা এখন বিকাশ, নগদের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। এই উদ্যোগে জড়িত ৯৫ শতাংশ পরিবার-ই এখন প্লাস্টিক বিক্রয়ে অংশ নিচ্ছে, যাদের এক তৃতীয়াংশ আবার এই উদ্যোগটি চালু হওয়ার পর যুক্ত হয়েছে। এটিকে এই উদ্যোগের একটি সামাজিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে প্রায় ২৪৯ টনই প্লাস্টিক বর্জ্য। এর একটি বড় অংশ সংগ্রহ না হওয়ায় এই প্লাস্টিক খাল-নালা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে পরিবেশ দুষণ, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং শহরের জলাবদ্ধতাকে প্রকট করে তোলে। এই পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ এবং উন্নয়ন সংস্থা ইপসার মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি চালু হয়।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল শহরের ৪১টি ওয়ার্ডজুড়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সার্কুলার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মডেল তৈরি করা । এই উদ্যোগটি কার্যকর করার জন্য ৩ হাজারেও বেশি বর্জ্যকর্মীকে নিরাপদভাবে বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এক হাজার ৮২৭ জন বর্জ্য সংগ্রাহক ও ভাঙ্গারিওয়ালাকে আনা হয়েছে গ্রুপ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আওতায়। এই ইন্স্যুরেন্সে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর জন্য সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা এবং চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচের নিশ্চয়তা রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ এবং ইপসার ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগটি স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এটি সম্ভব হয়েছে ১৫ হাজারেওও বেশি এবং ৭ হাজার স্কুল শিক্ষার্থীকে উৎসস্থলে বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পুনর্ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতার কারণে। গবেষণায় বলা হয়, সংগৃহীত প্লাস্টিক বিক্রি-ই এখন অনেক পরিবারের অতিরিক্ত আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৯৯ শতাংশ বর্জ্যকর্মীই জানিয়েছে তাদের মাসিক আয়ে উন্নতি হয়েছে।
৯১ শতাংশ এখন নিয়মিত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। ফলে তাদের অসুস্থতা ও দুর্ঘটনার হার আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। অপরদিকে, ৯২ শতাংশ ভাঙ্গারিওয়ালা জানিয়েছে, এখন তারা উন্নতমানের প্লাস্টিক পাচ্ছেন এবং এতে তাদের নতুন নতুন বাজার সংযোগ তৈরি হয়েছে। আর এই সংযুক্তির ফলে ব্যবসার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আয় ও স্থিতিশীলতা দুই দিক থেকেই ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
পরিবেশগত দিক থেকেই এই উদ্যোগ ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই উদ্যোগের আওতায় ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরী থেকে ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, যা শহরের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রায় ১০ শতাংশ। সংগৃহীত এই প্লাস্টিক পুরোপুরি রিসাইকেল করা হয়েছে। এর ফলে ৬ হাজার ৭২ কার্বন ডাই অক্সাইড কমানো সম্ভব হয়েছে। এটি হাজার হাজার ট্রাকে প্লাস্টিক ল্যান্ডফিলে পাঠানোর সমপরিমাণ নির্গমন রোধের সমান।
উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো বলছে, আশপাশের পরিবেশ এখন আগের চেয়ে পরিষ্কার, নালা-নর্দমা জ্যাম জ্যাম হয় এবং জলাবদ্ধতাও অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উদ্যোদটি বাংলাদেশের জাতীয় প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা ও জাতিসংঘের প্লাস্টিক চুক্তির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সঙ্গেও সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাছাড়া প্রকল্পটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শহর গঠনের মডেল হিসেবে কাজ করছে। এই প্রকল্পের নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে চট্টগ্রাম শহর একটি পরিবেশবান্ধব নগর হিসাবে গড়ে উঠছে।
দেশের অন্যান্য শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও এই উদ্যোগ একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। ইউনিলিভার বাংলাদেশও মনে করে, অনানুষ্ঠানিক প্লাস্টিক সংগ্রাহকরাই টেকসই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। তাদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও জীবিকার নিশ্চয়তার মাধ্যমে এই উদ্যোগ একটি প্রতিফলনযোগ্য মডেল দাঁড় করিয়েছে, যেখানে করপোরেট দায়িত্ববোধ, স্থানীয় সরকার এবং সামাজভিত্তিক সংগঠন মিলিতভাবে পরিবেশবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করেছে। উদ্যোগটি কেবল একটি পরিবেশগত পরিবেশগত সমাধান নয়, এটি দেশের অন্যান্য শহরের জন্য একটি বাস্তবসম্মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের রূপরেখা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।