
পহেলা জুলাই থেকে ২০২৫-২৬ নতুন অর্থবছরের যাত্রা শুরু
পুরনো চ্যালেঞ্জ নিয়েই আগামীকাল মঙ্গলবার পহেলা জুলাই থেকে ২০২৫-২৬ নতুন অর্থবছরের যাত্রা শুরু হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থবছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, সরকারের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে। এর বাইরে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা ও রপ্তানি বাড়ানো এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, অর্থনীতিতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে। তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে সরকার।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে গত কয়েক মাসের তুলনায় এখন মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। এক অঙ্কের ঘরে অর্থাৎ ৯ শতাংশে নেমে এসেছে মূল্যস্ফীতি। আশা করা হচ্ছে, অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এই হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের ঋণের অর্থ রিজার্ভে যোগ হওয়ায় ফুলেফেঁপে উঠছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এর বাইরে পর্যাপ্ত রেমিটেন্স আহরণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া রপ্তানি বাজারও এখন ভালো।
ফলে সবকিছু মিলে রিজার্ভ পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম কমে আসায় বাংলাদেশেও এখন ডলারের দাম কম। গত কয়েক মাস আগে প্রতি ডলার ১২৭-১২৮ টাকা বিক্রি হলেও এখন ১২২.৭০-১২২.৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডলার। সামনে ডলারের দাম আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে ডলারের বাজারে।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান আন্দোলন পরিস্থিতির কারণে এখন রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় চলতে পারছে না। রাজস্ব আদায়ও ঠিকমতো হচ্ছে না। চলমান এই আন্দোলন প্রশমিত না হলে সামনের দিনগুলোতে আরও চ্যালেঞ্জ বাড়বে। গত কয়েকবছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারছে না এনবিআর। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারকে নতুন বছরের জন্য ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে ১২টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
সেগুলো হলো- ১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ২. রাজস্ব আদায়, ৩. দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ, ৪. বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, ৫. খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৬. দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, ৭. আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৮. শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, ৯. ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং সরকারি কর্মচারী তথা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, ১১. পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কৌশল এবং ১২. এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগ স্থবির, বেকারত্ব বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বৈদেশিক বাণিজ্যে টানাপোড়েন, খেলাপি ঋণে ঊর্ধ্বগতিসহ নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এটি মোকাবিলায় সমন্বিত নীতি গ্রহণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গত অর্থবছরের চেয়ে আকার প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বরাবরই বাজেট বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ও করের আওতা বাড়ানোর মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে সরকারের সামনে।
এছাড়া সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া প্রয়োজন। প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, ব্যাপক সমালোচনার মুখে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ও জনস্বার্থে বেশকিছু পণ্য আমদানিতে কমানো হয়েছে শুল্ককর। এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করাই বড় পরিবর্তন। প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট এবং ভবন কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল।
এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা মাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ইতোপূর্বে ঘোষিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা চাকরিরতদের জন্য ন্যূনতম ১ হাজার ৫০০ টাকা ও পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫০ টাকা করা হয়েছে।
নিট পেনশন ১৭ হাজার ৩৮৮ টাকার ঊর্ধ্বে পাওয়ার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ও এর নি¤েœর ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, বিচারপতি ও এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে পৃথক আদেশ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি, দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি ও আলোচনা এবং শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো প্রধান চ্যালেঞ্জ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সংকট এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সংকটে শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগ স্থবিরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বাজেটে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। করের হার না বাড়িয়ে ভিত্তি বাড়াতে হবে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আহরণ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়াসহ বর্তমানের সার্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটও উচ্চাভিলাষী। বাস্তবায়নযোগ্য করার জন্য আরও ছোট করা উচিত।