
সর্বোচ্চ রেমিটেন্স
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হওয়ার দুদিন আগেই প্রবাসীরা দেশে ৩০.০৫ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৫ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। একক অর্থবছর হিসাবে এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবাসী আয়ের রেকর্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো একক অর্থবছরে আর এত বেশি রেমিটেন্স দেশে আসেনি। সেই সঙ্গে এই প্রথম বাংলাদেশ রেমিটেন্স তথা প্রবাসী আয়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এই রেকর্ড রেমিটেন্সে দেশের রিজার্ভ একটি সুসংহত অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের এই রেকর্ড রেমিটেন্স আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫.৫০ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২৮ জুন পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে একক অর্থবছর হিসেবে সর্বোচ্চ পরিমাণে রেমিটেন্সে রেকর্ড হয় ২০২০-২১ অর্থবছরে। সেই সময়ে কোভিডের কারণে হুন্ডির চ্যানেলগুলো বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠান। এদিকে চলতি জুন মাসের ২৮ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ২.৩৭ বিলিয়ন ডলার।
রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি জুন মাসের প্রথম ২৮ দিনে ২৫৩ কোটি ৯২ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন লাখ ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩৬ কোটি ১২ লাখ ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৬১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
এর আগেও প্রবাসী আয় প্রবাহে ইতিবাচক ধারা ছিল। গত মে মাসে দেশে এসেছে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তারও আগে মার্চ মাসে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিটেন্স এসেছে। আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ, অক্টোবরে এসেছে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। পরের মাস নভেম্বরে এসেছে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে এসেছে ২৬৪ কোটি ডলার। এরপর চলতি বছরের জানুয়াতে ২১৯ কোটি ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। এ ছাড়া মার্চে ৩২৯ কোটি ডলার, এপ্রিলে আসে ২৭৫ কোটি ডলারের রেমিটেন্স। সবশেষ মে মাসে ২৯৭ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিটেন্স প্রবাহ শুধু প্রবাসী পরিবারের আয় বাড়ায় না বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখে। এদিকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠাতে প্রবাসীদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে। ডিজিটাল চ্যানেলে অর্থ পাঠানো সহজ হওয়ায় এখন অনেকেই হুন্ডি এড়িয়ে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল বেছে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে নানা উদ্যোগ, উৎসবকেন্দ্রিক আয় বৃদ্ধি ও অবৈধ পথে প্রেরণ নিরুৎসাহিত করায় এই প্রবাহ বাড়ছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিপুল রেমিটেন্স এলেও এখনো বড় অঙ্ক অবৈধ পথে চলে যাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে বৈদেশিক শ্রমবাজারে ৯ লাখ ৬ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী যুক্ত হয়েছেন। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে পাঠানো জনশক্তির অঙ্ক ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ ৭৫ হাজার ৪৮৭ জন। এই বিপুল জনশক্তির অর্জিত আয় বৈধপথে দেশ আনতে পারলে বাৎসরিক রেমিটেন্সের অঙ্ক ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত।
রেমিটেন্স আয়ের দিক থেকে ২০২৪ সালে বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশে সাড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। শীর্ষে ছিল ভারত। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি ব্লগের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু। ভারত ২০২৪ সালে আনুমানিক ১২৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পেয়েছে। যা যেকোনো দেশের এক বছরে পাওয়া সর্বোচ্চ রেমিটেন্স। এ ছাড়া, গত বছর বৈশ্বিক রেমিটেন্সের মধ্যে ভারত একাই নিয়ে গেছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
এই অঙ্কও চলতি শতকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। গত বছর রেমিটেন্স অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল মেক্সিকো। দেশটির প্রবাসীরা দেশটিতে ৬৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। তৃতীয় স্থানে থাকা চীনা প্রবাসীরা নিজ দেশে পাঠিয়েছেন ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চতুর্থ স্থানে থাকা দেশটি হলো ফিলিপাইন। দেশটির প্রবাসীরা দেশটিতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। পঞ্চম স্থানে থাকা দেশটি হলো ফ্রান্স। দেশটির প্রবাসীরা গত বছর মোট ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। তালিকার ষষ্ঠ স্থানে আছে পাকিস্তান। গত বছরে দেশটি ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পেয়েছে। সপ্তম স্থানে থাকা বাংলাদেশ গত বছর রেমিটেন্স পেয়েছে ২৬ দশমিক ৬৮৯ বিলিয়ন ডলার ।
রেমিটেন্স আয়ের দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে থাকা দেশটির নাম মিসর। দেশটির প্রবাসীরা গত বছর নিজ দেশে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন এবং নবম ও দশম অবস্থানে থাকা দুই দেশ যথাক্রমে গুয়াতেমালা ও জার্মানি। উভয় দেশের প্রবাসীরা নিজ নিজ দেশে সাড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।