ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

দ্বিমুখী স্বাস্থ্য সংকট ॥ প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৭:৫০, ২৯ জুন ২০২৫

দ্বিমুখী স্বাস্থ্য সংকট ॥ প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ

বাংলাদেশ আজ একটি জটিল স্বাস্থ্য পরিস্থিতির মুখোমুখি। কোভিড-১৯ এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট এবং ডেঙ্গুর ক্রমাগত বিস্তার একযোগে আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কিন্তু এই সংকট থেকে আমাদের শিখতে হবে এবং আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। 
২০২৫ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের নতুন ঢেউ পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে যা আমাদের সতর্ক করে তুলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০টি নতুন কেস নিশ্চিত হওয়ার পর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ১১ দফা নির্দেশিকা প্রকাশ করেছেন। কয়েকজন ইতোমধ্যেই শনাক্ত হয়েছেন, কেউ কেউ মারাও গেছেন।
তবে এবারের পরিস্থিতি আগের থেকে আলাদা। আমরা এখন জানি যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হতে পারে। মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত ধোয়ার মতো সহজ অভ্যাসগুলো ভাইরাসের বিস্তার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো জনসাধারণের মধ্যে এই সচেতনতার অভাব।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে। আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু উদাসীনতাও বিপজ্জনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) মতে, পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণযোগ্যÑ তবে তার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত দায়বদ্ধতা।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে আমাদের সীমান্ত এলাকায় বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের স্ক্রিনিং, প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা জোরদার করতে হবে। বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং স্থলসীমান্তগুলোতে থার্মাল স্ক্রিনিং ও দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।
অন্যদিকে ডেঙ্গু এখন আর কেবল বর্ষাকালীন সমস্যা নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে এটি সারা বছরের হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এডিস মশা এখন বিভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং তার আচরণ পরিবর্তন করেছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় প্রতি ১৫টি বাড়ির মধ্যে ৭-৮টিতে এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল উদ্বেগজনকই নয়, বরং আমাদের ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মৌলিক ত্রুটির প্রমাণ। ২০২৩ সালে ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এবং ১,৫০০ এর বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সাল আরও মারাত্মক হতে পারে। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র এখন আর শুধু প্রাকৃতিক জলাশয়ে সীমাবদ্ধ নেই। বাড়ির ছাদের পানির ট্যাঙ্ক, ফুলের টব, এয়ার কন্ডিশনারের ড্রেন, এমনকি পরিত্যক্ত টায়ার ও প্লাস্টিকের পাত্রেও এরা বংশবিস্তার করছে। এই বাস্তবতা আমাদের নিয়ন্ত্রণ কৌশল পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করেছে।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যয় এখনো জিডিপির মাত্র ২.৫% এর মতো, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত ৫% এর অর্ধেক। এই সীমিত বরাদ্দ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতার মূল কারণ। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত আইসোলেশন ইউনিট, আইসিইউ বেড এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। জরুরি অবস্থায় এই ঘাটতি প্রকট হয়ে ওঠে। অনেক হাসপাতালে এখনো পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম, দ্রুত পরীক্ষার কিট এবং অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও দুর্বল। কমিউনিটি ক্লিনিক এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো প্রায়ই জনবল ও সরঞ্জামের অভাবে পূর্ণ সেবা দিতে পারে না। ফলে রোগীরা জটিল অবস্থায় পৌঁছানোর পর বড় হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়।
স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জনসাধারণের আচরণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা, যা শুধুমাত্র সরকারি পদক্ষেপেই সম্ভব নয়, দরকার ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ। কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের পর জনগণের মধ্যে এক ধরনের ক্লান্তি ও আত্মতুষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই ভুলভাবে বিশ্বাস করেন যে মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময় পেরিয়ে গেছে, ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আগ্রহ কমে গেছে। ভিড়ভাট্টা পূর্ণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, সামাজিক অনুষ্ঠানে অসতর্ক আচরণ এবং মাস্ক পরিধানে অনীহা এ ধরনের মনোভাবের প্রতিফলন। ডেঙ্গুর মতো রোগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ এটি প্রতিরোধে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। কিন্তু অনেক পরিবারই ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখার গুরুত্ব বুঝতে পারে না, আবার কেউ কেউ জানলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় না। এর পেছনে রয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও জনসচেতনতার ঘাটতি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় মানুষ প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে না, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে।
নতুন কৌশল ও সমাধানের পথনির্দেশনা দিতে হলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, কমিউনিটি সম্পৃক্ততা, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি এবং ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থার সমন্বিত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে স্বাস্থ্য নজরদারি ব্যবস্থা আরও কার্যকর করা সম্ভব। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত ও ট্র্যাক করা, জিআইএস প্রযুক্তি দিয়ে মশার উপদ্রব বিশ্লেষণ এবং এআই-ভিত্তিক পূর্বাভাস ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভাব্য রোগপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্গম এলাকায় ওষুধ স্প্রে এবং মশার লার্ভা শনাক্তকরণও অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। টেলিমেডিসিন সেবা আরও সম্প্রসারণ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ সহজলভ্য করে তোলা যায়।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা অপরিহার্য। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা যেন জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল ও কলেজে স্বাস্থ্য ক্লাব গঠনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে স্বাস্থ্য সচেতনতায় যুক্ত করা যায়। পাশাপাশি, পরিবেশবান্ধব মশা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে লার্ভা খেকো মাছ, ব্যাকটেরিয়াভিত্তিক লার্ভানাশক এবং জেনেটিক পরিবর্তিত মশা ব্যবহারের গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় সঠিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, সবুজ স্থান সংরক্ষণ এবং উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারে। সবশেষে, রোগ নজরদারি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাকে ডিজিটাল ও একীভূত করতে হবে, যাতে রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা যায়।
ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে আমাদের একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই স্বাস্থ্য কৌশল গ্রহণ করতে হবে। বহুমুখী রোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশলের আওতায় ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া ও ইয়েলো ফিভারের মতো সব ভেক্টরবাহিত রোগ মোকাবিলায় একটি অভিন্ন স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা সময় ও সম্পদের অপচয় রোধ করবে। পাশাপাশি, স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভ্যাকসিন ও ওষুধ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন জরুরি। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি-জ্ঞান বিনিময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রোগের প্রকৃতি ও বিস্তারে যে পরিবর্তন আসছে, তা মোকাবিলায় আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও নমনীয়, অভিযোজিত ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল করে গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিত দায়বদ্ধতা অত্যন্ত জরুরি, যা শুধু সরকার বা চিকিৎসক সমাজের একক দায়িত্ব নয়। প্রতিটি নাগরিক, পরিবার এবং সম্প্রদায়কে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে এই চ্যালেঞ্জে। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং অন্যদের সচেতন করার মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করা সম্ভব। সরকারের দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, বাস্তবমুখী নীতিমালা প্রণয়ন এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। স্থানীয় সরকার, এনজিও এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ও এই প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য। বাংলাদেশ অতীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে; এখন সময় এসেছে স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় একইরকম সক্ষমতা অর্জনের। এর জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, আন্তঃখাত সহযোগিতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আজকের এই সংকটকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় রূপান্তর করার সুযোগ রয়েছে আমাদের হাতে। আমরা সবাই মিলে একটি স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ এবং সচেতন বাংলাদেশ গড়ে তুলিÑ যেখানে প্রতিরোধই হবে প্রধান হাতিয়ার এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সকলে থাকবে সম্মিলিতভাবে দায়বদ্ধ।

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×