
স্বস্তি সাময়িক, সুখ অপেক্ষাকৃত স্থায়ী। আবার দীর্ঘকালের স্থায়ী সুখের অপর নাম শান্তি। এই স্বস্তিমুখর সুখ অর্জনই মানুষের মুখ্য উদ্দেশ্য। শুধু এখন নয়, আদিকাল থেকে আপনজন নিয়ে শান্তিতে থাকা মানুষের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য মানুষ সময় থেকে সময়ান্তর, লোক থেকে লোকান্তর এমনকি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে ফিরছে। আলোর দিকে পতঙ্গ যেমন উড়তে থাকে তেমনি সুখের খোঁজে এদেশের মানুষ প্রবাসী হতে দ্বিধা করে না। কিসের সুখ? আর্থিক সচ্ছলতার সুখ। পরিবার চালানো ও সবার ভরণপোষণ এবং সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য অর্থ দরকার। এজন্যই উপার্জন করতে হয় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করতে হয়।
এ দেশের মানুষ প্রবাসে যায় বড় আকাক্সক্ষা নিয়ে। হয়তো এবার তার ভাগ্য খুলবে। দেখা যাবে অসচ্ছল পরিবারে অর্থ নামক পূর্ণিমার চাঁদ। এই আশায় ঘর-বাড়ি, জমি বন্ধক রেখে, এমনকি বিক্রি করেও বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমায়। পরিবারের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত স্মৃতি হয়ে থাকে। দেখতে পারে না মায়ের মুখ, অসুস্থ বাবার ওষুধ নিজ হাতে কিনতে পারে না, ভাইয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারে না। এমনকি বংশ ও পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করলে নিজ হাতে দাফন করার সুযোগও হয় না। ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তার নিজ দেশ, শৈশবে কাটানো বন্ধুদের আড্ডা। রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে যেতে হয় বিদেশে, অর্থ নামক সচ্ছলতার খোঁজে। অনেকে আবার প্রবাস থেকে ফেরেই না। চিরকালের জন্য প্রবাসী হয়ে যায়। কবরে শায়িত হতে দেশে ফিরে আসে নিথর দেহ। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির লাশ টানা বৃদ্ধ পিতার দ্বারা সম্ভব হয় না। তার বাচ্চাটা কাঁদতে থাকে। কিন্তু সে জানে না কেন কাঁদছে। মায়ের কান্না দেখে সেও কাঁদে। প্রবাসী দেখতে পারে না তার সন্তান কীভাবে মায়ের পেটে বেড়ে উঠছে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে পারে না। বাচ্চার বেড়ে ওঠা দেখতে হয় দূর থেকে ভিডিও কলে। কিন্তু স্পর্শ করতে পারে না।
এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে বেঁচে থাকার পরেও ছুটিতে নিজ দেশে ফেরার সময় হেনস্থার শিকার হতে হয়।
চুরি হয়ে যায় ট্রলি, গচ্ছিত সম্পদ, স্ত্রীর জন্য কেনা উপহার, পিতা ও মাতার জন্য নিয়ে আসা অমূল্য কিছু। এমনকি এদেশে এয়ারপোর্ট থেকে প্রবাসীর পাসপোর্টও হারিয়ে যায়। মার খাওয়ার নজিরও আছে অহরহ। যাদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশ টিকে আছে, তাদের অমানবিক কার্যকলাপের সম্মুখীন হতে হয়।
কথায় আছে, অর্থই সব অনর্থের মূল। না, সব অর্থ অনর্থের মূল নয়। বরং সৎ পথে ব্যয় না করে, যাচ্ছেতাই লাগামহীন খরচ ও অবৈধ পথে অর্থ ব্যয় তার মালিকের অনর্থ ডেকে আনে। তবে প্রবাসীদের বৈধ উপার্জন সত্ত্বেও পরিবার থেকে অনূচিত আচরণের শিকার হতে হয়। কারণ প্রবাসীর পরিবার তাকে টাকার মেশিন মনে করে। হাড়ভাঙা খাটুনির পরও তাকে মূল্যায়ন করা হয় না।
সম্প্রতি এক ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, এক প্রবাসী ছেলে ঈদে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বিমানের টিকিট কেটেছে। কিন্তু একথা সে কাউকে জানায়নি বাড়ির লোকদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে জানাজানি হলে তার মা তাকে প্রবাস থেকে আসতে নিষেধ করে এবং সে যদি বাড়ি আসে তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে জানিয়ে দেন। এভাবেই অবৈধ উপার্জন না করেও প্রবাসীদের অনর্থের সম্মুখীন হতে হয়।
সমাজে এমন ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়, যদিও এটা অনাকাক্সিক্ষত। বিদেশ যাওয়ার সময় প্রবাসী রেখে যায় একজন বিশ্বস্ত সঙ্গিনী। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কেউ কেউ আর বিশ্বস্ত থাকে না। জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়। অসম বয়সের কারোর হাত ধরে পাড়ি জমায় অজানার উদ্দেশ্যে। ফেলে যায় এক বা একাধিক সন্তান। তারা বেড়ে উঠতে থাকে অবহেলায়। প্রবাস থেকে পাঠানো অর্থও নিয়ে যায় সেই সঙ্গিনী। আবার প্রবাসীর সম্পদ জব্দ করে পরিবারের অন্য সদস্যরা। বিদেশ থেকেই সে নির্যাতিত হয় আর্থিক এবং মানসিকভাবে। তার দুঃখ কেউ বুঝতে চায় না। কারণ মনের আঘাতই তো বড় আঘাত।
আসলেই কি অর্থের ভেতরে সুখ নিহিত? হ্যাঁ। কিছু অংশ হলেও অর্থের মধ্যে সুখ বিদ্যমান। কারণ প্রবাসীর পাঠানো রেমিটেন্সের ফলেই এদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। বড় প্রকল্প করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের জনসাধারণ সুখের আশায় বুক বাঁধতে পারছে। সরকারি তথ্যমতে, দেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিটেন্স এসেছে ২.৯১৬ লাখ কোটি টাকা, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের প্রায় ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের হিসাব করলে ৩৭ শতাংশের অধিকাংশই নির্ভর করছে প্রবাসীর পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর।
একজন প্রবাসীর কষ্টের সঙ্গী হয় না কেউ। সে নিষ্পেষিত হয় স্ত্রীর কাছে, সন্তানের কাছে। অমানবিকতার শিকার হয় পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে। যেই রাষ্ট্রের জন্য এতকিছু করল, সেই রাষ্ট্রের কাছেও মূল্য পায় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। হয়তো ব্যতিক্রমের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, উপরের পরিস্থিতে পড়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
তাই আমাদের উচিত প্রবাসীদের সম্মান করা। তাদের ত্যাগের কথা মাথায় রাখা। রাষ্ট্রের প্রতি তাদের অবদান স্বীকার করা। স্ত্রীর উচিত প্রবাসী স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। পরিবারেরও উচিত প্রবাসীকে টাকার মেশিন মনে না করে মানুষ মনে করা। সমাজের উচিত প্রবাসীদের মূল্যায়ন করা। কারণ তাদের জন্যই এখনো এদেশে সমাজের অস্তিত্ব টিকে আছে। পরিশেষে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব রেমিটেন্স যোদ্ধাদের গুরুত্ব দেওয়া। ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কোনো এজেন্সি বা দালাল কর্তৃক প্রতারিত হওয়ার পথ বন্ধ করা। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের অ্যাম্বাসি ও হাইকমিশন কর্তৃক খোঁজ নেওয়া ও তাদের বৈধতার লিস্ট করা। কোনো প্রবাসী যেন সরকারের হিসেবের বাইরে না থাকে সেই ব্যবস্থা নেওয়া। সর্বোপরি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আমাদের প্রবাসীরা যেন সর্বোচ্চ সহযোগিতা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাহলেই একটি সুখী ও সমৃদ্ধ এবং রেমিটেন্সভিত্তিক বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
প্যানেল