
বেকারত্বের সমস্যা
বাংলাদেশ ২০২৫ সালে এসে বিশ্বের দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু দেশের এক বড় দিক এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন- বেকারত্বের সমস্যা। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে এই দীর্ঘস্থায়ী অশান্তি। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী প্রতিদিন চাকরির সন্ধানে হতাশ হয়ে ঘুরছেন। বেকারত্ব একক কোনো কারণের ফল নয়। এটি একটি জটিল সমস্যার নাম, যার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো-
শিক্ষার মানের দুর্বলতা: দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। বহু গ্র্যাজুয়েট আজও হাতে শুধু একটি ডিগ্রি নিয়ে বের হয়, যার সঙ্গে বাস্তব দক্ষতার ফারাক গাঢ়। কারিগরি শিক্ষার অবহেলা: কারিগরি ও মেকানিক্যাল শিক্ষা প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে পিছিয়ে থাকায় তরুণরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন থেকে বঞ্চিত।
অপ্রতুল কর্মসংস্থান: শিল্প ও সেবা খাতের পর্যাপ্ত প্রসার না হওয়া, ব্যবসার অব্যবস্থা, বিনিয়োগের সংকটÑ এসব কারণে চাকরির সুযোগ সীমিত।
অপ্রতুল উদ্যোক্তা মনোভাব: ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের যথাযথ সহায়তা না পাওয়া ও ঝুঁকি থেকে বিরত থাকায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ কম।
অর্ধশিক্ষিত ও অযোগ্য জনশক্তি: দেশের বয়স্ক ও তরুণ শ্রমশক্তির অনেকেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞানে অনুপযুক্ত।
রাষ্ট্রীয় নীতির ঘাটতি ও অবহেলা: দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান নীতিমালা ও বাস্তবায়নে অসামঞ্জস্য ও দুর্বলতা।
বেকারত্ব শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি রাষ্ট্রের জন্য একটি গভীর নিরাপত্তা ও সামাজিক সংকট। উচ্চ বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয় সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধ প্রবণতা ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি। আর্থিকভাবে দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়। দেশের গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন না হলে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন ম্লান হবে। বেকারত্বের হার কমাতে রাষ্ট্রকে অবশ্যই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যেমন-
শিক্ষার মান উন্নয়ন: শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাজারমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার সমন্বয় বাড়াতে হবে। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা প্রসার: কারিগরি শিক্ষার মান ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে দক্ষতা ও বাস্তব কর্মপরিবেশে অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে হবে।
উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসার সহায়তা: সরকারি প্যাকেজ ও নীতিমালা উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি কমাবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
কর্মসংস্থান বান্ধব পরিবেশ: শ্রম বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সার্বিক রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা: দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মসংস্থান নীতি গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। জনসংখ্যা, শিক্ষা, শিল্প ও সেবা খাতের সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নে নজর দিতে হবে।
বেকারত্বের আরও একটি বড় কারণ নারীদের পিছিয়ে পড়া। নারীদের কর্মসংস্থানের অভাব নিয়ে এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নারীদের অবদান অপরিহার্য। কিন্তু ২০২৫ সালের বাংলাদেশেও নারীদের কর্মসংস্থানে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া নারীরা তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা প্রকাশে সীমাবদ্ধ থাকেন। তাই নারীদের জন্য কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানসিক ও সামাজিকভাবে উৎসাহিত করা এবং কাজের প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
নারীরা যখন সুরক্ষিত ও প্রেরণাপ্রাপ্ত বোধ করবে, তখনই তারা শ্রমবাজারে প্রবল অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। রাষ্ট্র ও সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বাধা দূর করতে এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে।
পরিশেষে, বেকারত্ব আমাদের দেশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভয়াল সংকট, যা শুধু নির্দিষ্ট একটি বিভাগ বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা সমাধান করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং রাষ্ট্রীয় সঠিক নীতি। ২০২৫ সালের বাংলাদেশে বেকারত্ব কমাতে হলে এখনই সময় কর্তৃপক্ষের আন্তরিক ভূমিকা ও সমগ্র সমাজের সচেতনতা গড়ে তোলার। শিক্ষা যদি মানসম্মত হয়, কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং উদ্যোক্তাদের প্রেরণা বৃদ্ধি পায়, তবেই আমরা বেকারত্বের ভয়াল আঁধার কাটিয়ে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারব।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়