
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সমৃদ্ধ করতে যাঁদের অবদান অনন্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদের অন্যতম। তিনি শুধু একজন কবিই নন, ছিলেন এক সাহসী চিন্তক ও বিদ্রোহী সাহিত্যিক, যাঁর কলম বাংলা ভাষাকে নতুন এক গতি দিয়েছিল।
আজ ২৯ জুন—বাংলা সাহিত্যের মহাকবি খ্যাত মধুসূদনের ১৫২তম প্রয়াণ দিবস। ১৮৭৩ সালের এই দিনে কলকাতার আলীপুর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর জীবন ছিল বর্ণময়, কিন্তু শেষ অধ্যায়টি ছিল করুণ ও নিঃসঙ্গ।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই সাহিত্যেই সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন ১৮৪৩ সালে, যার ফলে সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সেই বিচ্ছিন্নতা তাঁকে চিরজীবনের এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু সাহিত্যকে করেন জীবনের সহচর।
ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি শুরু করলেও শেষপর্যন্ত শেকড়ের টানে নীড়ে ফিরতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে বাংলাতেই মহাকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। মেঘনাদবধ কাব্য সৃষ্টি করে বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যিক ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন।
তিনি বাংলা সনেটের প্রবর্তক। তাঁর চতুর্দশপদী কবিতা সংকলনে ক্লাসিক্যাল ইউরোপীয় ধারায় তিনি বাংলা কবিতার আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে স্থাপন করেন।
সাহিত্যজীবনে উজ্জ্বল হলেও ব্যক্তিগত জীবনে মধুসূদন ছিলেন এক ব্যর্থ ও বেদনাহত মানুষ। ইউরোপীয় জীবনযাত্রার আকর্ষণে প্যারিসে পাড়ি জমালেও এক সময় কলকাতায় আশ্রয় নেন। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন, সন্তানদের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে থাকেন। শারীরিক দুর্বলতা, আর্থিক অভাব ও মানসিক চাপ একত্র হয়ে তাঁর শেষ দিনগুলোকে করে তোলে এক অসহায় অপেক্ষা।
জীবনবেলার শেষ প্রান্তে এসে তিনি তাঁর বন্ধু রেভারেন্ড লঙকে লিখেন, "What shall I do? I am poor-helpless-without a home!"
এই একটি বাক্যে ফুটে ওঠে তাঁর অন্তিম জীবনের সারসংক্ষেপ—দুঃখ, তীব্র নিঃসঙ্গতা এবং আর্তি। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে আলীপুর জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেই ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে, নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ ও শ্রান্ত অবস্থায় কবি পৃথিবীর মঞ্চ থেকে বিদায় নেন।
মধুসূদনের মৃত্যুর পর প্রথমদিকে সমাজ ও সাহিত্যে তেমন সাড়া না দেখা গেলেও, কালের পরিক্রমায় তাঁর অবদান স্বীকৃত হয়। তিনি আজ বাংলা সাহিত্যের এক অবিসংবাদিত দিকপাল, যাঁর কাব্যিক সৌন্দর্য, ভাষার কাঠামোগত বিপ্লব এবং চিন্তার গভীরতা আমাদের সাহিত্যের পথচলায় আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমরা স্মরণ করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামক এক অভূতপূর্ব প্রতিভাকে—যিনি শুধু সাহিত্যে নয়, জীবন দর্শনেও আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন: সাহিত্য শুধু সৌন্দর্যের রস নয়, প্রতিবাদ ও আত্মপরিচয়ের চিরন্তন উচ্চারণ।
সানজানা