
ছবি সংগ্রহীত
ইসরাইলি নৃশংসতা, শিশুদের কান্না, হাজারো মৃত্যু ও বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে যখন প্রায় নিশ্চিহ্ন ফিলিস্তিনবাসীর ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব রাজনীতির স্বার্থকেন্দ্রিক নিষ্ক্রিয়তার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই মধ্যপ্রাচ্যের গাজা, তখন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবতাবোধের চূড়ান্ত পরীক্ষায় একত্রে উত্তীর্ণ হওয়ার শপথ নিয়ে একাই এগিয়ে আসে ইরান, শুরু হয় নতুন অধ্যায়, ‘ইরান-ইসরাইল সংঘাত’।
কিন্তু ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার সাম্প্রতিক এই সংঘাত বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রজুড়ে পুরোপুরি বিস্তার লাভের আগেই, পশ্চিমা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে চূড়ান্তভাবে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। সেই সূত্র ধরে, ১৩ জুন ইসরাইলের হামলার জবাবে ইরান পাল্টা আক্রমণ চালালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২১ জুন বি২ বোমারু বিমান পাঠিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালান।
তার ঠিক পরদিন, পারস্য উপসাগরে যাওয়ার একমাত্র প্রবেশপথ, হরমুজ প্রণালী বন্ধের অনুমোদন দেয় ইরান। ফলস্বরূপ, আবারও প্রশ্নের মুখে বিশ্ববাণিজ্য ও ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক পরিস্থিতি।
বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের ২১ শতাংশ চাহিদা পূরণ করা এই প্রণালী বন্ধের পরপরই, বেশকিছু জাহাজ প্রণালীর অভিমুখে এসেও ফেরত যেতে বাধ্য হয়। বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের দেওয়া এক তথ্য অনুযায়ী, ‘যদি হরমুজ প্রণালী দিয়ে তেল সরবরাহ এক মাসের জন্য অর্ধেকে নেমে আসে এবং পরবর্তী এগারো মাসে তা ১০ শতাংশ কমে যায়, তাহলে বিশ্ব বাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম অস্থায়ীভাবে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১১০ ডলারে পৌঁছতে পারে।’
হরমুজ প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ভোক্তা দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো। সেক্ষেত্রে, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র হিসেবে চলমান সংঘাত ও অর্থনৈতিক বিরূপ পরিস্থিতিতে, ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও।
ইতোমধ্যেই, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের দেওয়া এক সূত্র থেকে জানা যায়, যুদ্ধ শুরুর আগে অর্থাৎ ১ থেকে ১১ জুন তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৭৬ থেকে ৭৯ ডলার। কিন্তু ১২ জুন যুদ্ধের পর থেকে ডিজেলের দাম বেড়ে ৮১ থেকে ৮৩ ডলারে পৌঁছে। ফলে, ডিজেলের দাম যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, পণ্যের দামও উঠানামা করবে, বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও, ব্যাহত হতে পারে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ। ইরান ইসরাইলের মধ্যে চলমান এই যুদ্ধ যদি গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে দেখা দিতে পারে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা। ফলে, প্রবাসী শ্রমিক ছাঁটাই, ভিসা জটিলতা ও নিরাপত্তাহীনতার কারনে কমে যেতে পারে কাজের সুযোগ। রেমিট্যান্স প্রবাহ সংকুচিত হলে, কমতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। ডলারের সংকট দেখা দিলে, কমে যেতে পারে টাকার মানও।
মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতের ফলে, নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পগুলোতেও। কেননা, ২০১৭ সালে সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ একত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যে অর্থসহায়তা দিত, তা দিয়ে সাধারণ লক্ষ্যমাত্রার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের আরও অন্যান্য অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় বেড়ে যাওয়ায়, সহায়তা তহবিল কমে দাঁড়ায় ৫৫ কোটি ডলারে, যা লক্ষ্যের মাত্র ৬৫ শতাংশ। দুঃখের বিষয়, বর্তমান সময়ে, এই তহবিল প্রাপ্তিতেও দেখা দিচ্ছ নানান অসুবিধা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক সহায়তা তহবিল সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। যার ফলে, খাদ্য সহায়তা, সুচিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকেই জীবনের তাগিদে বেআইনি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন, জড়িয়ে পড়ছেন সন্ত্রাসবাদে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন নতুন করে ইরান-ইসরাইল সংঘাত এবং সেই সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে যাওয়ায়, রোহিঙ্গা সংকট থেকে বিশ্ব মনোযোগ দীর্ঘমেয়াদে মুখ ঘুরিয়ে নিলে, বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি মোটেও সুখকর হবে না।
এছাড়া, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশের ভোক্তা ইউরোপীয় দেশগুলো। সে হিসেবে, বাংলাদেশ ইউরোপীয় সেসকল দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্রপথই বেশি ব্যবহার করে। চলমান যুদ্ধে সমুদ্রপথে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিলে, রপ্তানি আয়ে ব্যাঘাত ঘটবে। পাশাপাশি, আমদানি খাত ও উৎপাদন খাতেও সংকট দেখা দিতে পারে। কেননা, দেশীয় উৎপাদনে ব্যবহৃত মৌলিক কাঁচামাল যেমন- বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, ক্যামিকেল, প্লাস্টিক ইত্যাদি অধিকাংশই আমদানি করা হয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
এসব ছাড়াও যুদ্ধকালীন সময়ে, অর্থনীতিতে প্রভাববিস্তারকারী বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজ করছে দুশ্চিন্তা। ফলে, অর্থনীতিকে সচল রাখা বড় রাষ্ট্রগুলো এমন দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলোতে দেখা দিতে পারে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা। যার ফলে, নতুন শিল্প তৈরি ও অবকাঠামোগত খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অর্থনৈতিক এই অঘটন, প্রভাব ফেলতে পারে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় খাতেও।
সে যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ইরান-ইসরাইল সংঘাতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে গোটা বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রেই। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কিছুটা দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখার সর্বাত্মক চেষ্টায় সক্ষম হলেও, ক্ষতি পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে অক্ষম। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, এই যুদ্ধ বয়ে আনতে পারে একরাশ অশনিসংকেত। তাই, একটি সুন্দর ও সহযোগিতামূলক মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে, সহযোগিতামূলক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব এখনই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া এবং যুদ্ধবিরতি চূড়ান্তভাবে কার্যকর করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও মানবিক বিপর্যয় রোধে শক্ত অবস্থান নিশ্চিতকরণ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ
প্যানেল