
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পরও মার্কিন জনগণের মধ্যে সেই পুরোনো যুদ্ধ-প্রীতির সাড়া দেখা যায়নি। ২২ জুন, কোনো উসকানি ছাড়াই আমেরিকান যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশসীমায় ঢুকে ১৪টি ভারী বোমা ফেলেছে। এর আগে ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৬০০ ইরানি নিহত হয়। এই হামলা ছিল এক ধরনের পরিচিত ও পুরোনো ‘প্যাটার্ন’— মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা ফেলা, তারপর সেই ধ্বংসযজ্ঞকে ‘শান্তি আনার প্রচেষ্টা’ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই রাতে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের দস্যু ইরানকে এবার শান্তি করতে হবে।” অথচ বোমা ফেলে যে কষ্ট ও মৃত্যু ডেকে আনা হয়, সেটিকে ‘শান্তি’ বলে চালিয়ে দেওয়া এক ধরনের ভয়ানক প্রতারণা। এখানে ‘শান্তি’ মানে যেন পশ্চিমা শাসনের সামনে আত্মসমর্পণ।
ইসরায়েলের ১২ দিনের অবৈধ হামলায় ইরানে বহু শিশু নিহত হলেও পশ্চিমা গণমাধ্যমে সেই দৃশ্য অনুপস্থিত। বরং সেসব গণমাধ্যমে ইসরায়েলিদের বাংকারে লুকানোর গল্প গুরুত্ব পায়। গাজায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা অবরোধ ও হামলায় লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, সব হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে, স্কুলগুলো টার্গেট হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বললেও পশ্চিমা মিডিয়া সেই শব্দটি উচ্চারণ করতেও ভয় পায়। তারা হামলাকারীর বর্বরতাকে নরম ভাষায় উপস্থাপন করে। ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারা মিথ্যা বললেও তাদের বক্তব্যই মূলধারার মিডিয়ায় ছাপা হয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিবিসিতে একজন ইসরায়েলির মৃত্যুর খবর একজন ফিলিস্তিনির মৃত্যুর চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি কাভারেজ পায়। এই পক্ষপাতদুষ্টতা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।
ইরানকেও পশ্চিমা মিডিয়া একই রকম ভাষায় উপস্থাপন করে। কখনো রাষ্ট্র বা জনগণ হিসেবে নয়, বরং “শাসকগোষ্ঠী” কিংবা “হুমকি” হিসেবে তুলে ধরা হয়। “ইসলামিক” শব্দটি প্রতিবার জুড়ে দিয়ে এটিকে যেন ভয়ংকর কিছু হিসেবে প্রমাণ করতে চায় তারা। অথচ ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র নেই, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হাতেই সেই ভয়ংকর অস্ত্র রয়েছে।
তাহলে কেন ইরানকে এতটা ভয় দেখানো হয়? কারণ, ইরান এখনও পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেনি। তাকে অনেকবার নিষেধাজ্ঞা, গুপ্তহত্যা, নাশকতা ও অভ্যুত্থান দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তবুও দেশটি টিকে আছে।
তাই ইরানকে "পারমাণবিক হুমকি" বলে জনগণকে ভয় দেখানো দরকার হয়ে পড়ে। গত ৩০ বছর ধরে বলা হচ্ছে, ইরান “কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই” পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলবে— অথচ সেই ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সত্য হয়নি।
ভয় দেখানো গেলে প্রশ্ন তোলা বন্ধ হয়। মানুষ আর জানতে চায় না, কীভাবে “বিশ্বকে নিরাপদ রাখার” নামে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে।
পশ্চিমা মিডিয়ার প্রধান কাজ এখন সত্য উদ্ঘাটন নয়, বরং সহিংসতাকে ‘যুক্তিপূর্ণ’ করে তোলা। তারা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনকে প্রযুক্তির ভাষায় ও গ্রাফিক্সে মোড়ানো এক ধরনের ‘বিজ্ঞাপন’ হিসেবে উপস্থাপন করে।
টাইম ম্যাগাজিন “দ্য নিউ মিডল ইস্ট” শিরোনামে প্রচ্ছদ ছাপে, ঠিক যেমনটা ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় করেছিল। কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন আর ২০০৩ সাল নয়।
আজকের আমেরিকানরা আগের মতো সহজে ভুল বোঝেন না। এক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েল যখন ইরানে হামলা করে, তখন মাত্র ১৬ শতাংশ মার্কিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষে ছিলেন। ট্রাম্পের বোমা হামলার নির্দেশের পর আরেকটি জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৩৬ শতাংশ মানুষ হামলা সমর্থন করেন, এবং মাত্র ৩২ শতাংশ চান হামলা চালিয়ে যাওয়া হোক।
এই ব্যর্থতা জানিয়ে দেয় যে আমেরিকানদের চেতনায় পরিবর্তন এসেছে। তারা আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা আজও ভুলে যাননি। তারা স্মরণ করেন, সেই ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্রের’ মিথ্যা কথা, হাজারো মার্কিন সৈন্যের মৃত্যু, আর শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে অপমানজনক প্রস্থান।
দেশের ভেতরেও যখন ঘরবাড়াহীন ৭ লাখ মানুষ, ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, ২ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত— তখন সরকার যদি যুদ্ধের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে, জনগণ ক্ষুব্ধ হতেই পারে।
আর এই যুদ্ধের ছবি এখন সবাই মোবাইলেই দেখতে পায়— রক্তাক্ত শিশুর নিথর দেহ, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষ। মূলধারার মিডিয়া যেটা চাপা দিতে চায়, সেটাই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
এই বদলে যাওয়া বাস্তবতা বুঝে ট্রাম্পও পথ পাল্টান। ২৪ জুন তিনি সামাজিক মাধ্যমে লিখেন, “সিজফায়ার চলছে,” এবং ইসরায়েলকে বলেন “আর বোমা ফেলো না”।
তবে এই কথার আড়ালেও রয়ে গেছে ক্ষমতার নিষ্ঠুর চাল। ট্রাম্প চান, যেন যুদ্ধ করেও ‘শান্তির পুরুষ’ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। কিন্তু মানুষ এখন জানে, শান্তি মানে যুদ্ধ নয়। শান্তি বোমা নয়, বরং স্বাধীনতা।
ফিলিস্তিন থেকে ইরান— শত হামলার মধ্যেও সেই মানুষগুলো এখনও মাথা নত করেনি। তারা ভাঙেনি, বিকোয়নি, আর কারও ভয়ে নত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এবার সেই বাস্তবতাই টের পেয়েছে।
লেখক: ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান আইনজীবী
(আল জাজিরা থেকে অনূদিত)
এম.কে.