
ছবি: জনকণ্ঠ
বর্ষা আসছে। আষাঢ়ের শুরুতেই মুন্সীগঞ্জে নদীর স্রোত ভারী হয়ে উঠছে। পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতী—সব নদী যেন শ্বাস নিচ্ছে গভীর করে। গ্রাম-গঞ্জের খাল-বিলগুলোতে ঢুকে পড়ছে ঢল, টলমল করছে জল। এই জলই মুন্সীগঞ্জের জীবিকা, আবার এই জলই আতঙ্ক।
মুন্সীগঞ্জকে বলা হয় নদীর জেলা। পদ্মা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, ইছামতীর শাখা-উপশাখা বেয়ে বয়ে চলা এই ভূমি বছরের বড় সময়টাই শুষ্ক থাকে। গ্রীষ্মে নদী সরু হয়ে আসে, খাল-বিল শুকিয়ে কাদামাটি হয়ে ফেটে যায়।
বর্ষার আগমনে সেই মরা খালবিলে প্রথম জল আসে। শুকনো নৌকাগুলো নদীর কোলে ফিরে যায়। খালের বুকে শাপলা-শালুক ভেসে ওঠে। নৌকাঘাটে হাসি ফোটে জেলেদের মুখে।
“আমরা পানি না পেলে মরি। এখন বিল ভরছে, মাছ আসবে,” বলছিলেন সিরাজদিখানের এক জেলে।
বর্ষা এলে মুন্সীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামের খাল-বিলগুলো যেন নতুন করে জেগে ওঠে। শ্রীনগর, টংগিবাড়ী, লৌহজং, গজারিয়া, সদর—সব উপজেলায় নিচু জায়গাগুলোতে পানি ঢুকে পড়ছে।
বাচ্চারা খালে সাঁতার শিখছে। কিশোররা জাল-ছিপ নিয়ে মাছ ধরছে।পানি বাড়া মানে পোনা মাছ ছড়ানো শুরু হবে। স্থানীয় বাজারে শোল, ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি—সব মিলিয়ে সস্তা হবে মাছ। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো বর্ষাকালীন মাছ ধরে ঋণ শোধ করে, সংসার চালায়।
বর্ষার ঢল শুধু বিপদ নয়। পদ্মা-ধলেশ্বরীর পানি ফেলে রেখে যায় উর্বর পলিমাটি। বর্ষা চলে গেলে সেই মাটিতে হয় শীতকালীন সবজি, রবিশস্য, ধান।এ অঞ্চলের কৃষকেরা জানেন—বর্ষা ছাড়া তারা বীজ বুনতে পারবেন না। নদীর পানি তাঁদের সেচের বিকল্প। তাই বর্ষার আগমনে শঙ্কা থাকলেও মিশে থাকে স্বস্তি।
তবে নদীর টান শুধু আশীর্বাদ নয়। পদ্মা, ধলেশ্বরীর রুদ্ররূপ মুন্সীগঞ্জের অনেক পরিবারকে প্রতি বছর গ্রামছাড়া করে। লৌহজং, টংগিবাড়ীর নদীপাড়ে বর্ষা আসা মানেই আতঙ্কের দিন শুরু হওয়া।
“বর্ষা আসলেই বুক কাঁপে,” বলছিলেন এক বৃদ্ধা। “পদ্মা অনেকবার আমাদের ভিটা খাইছে।”
নদীর ভাঙনে হারানো ভিটা, নদীর ঢলে ভেসে যাওয়া ধান, স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, কাঁচা রাস্তা গলে যাওয়া—সবই বর্ষার অন্ধকার দিক।
বর্ষাকালে মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরও কম ভোগে না। কিছু বৃষ্টিতেই সড়ক বাজার, হাসপাতাল এলাকা, পুরনো কোর্ট চত্বর হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যায়।
ড্রেনেজ সমস্যায় শহরজুড়ে চলাচল ব্যাহত হয়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, রোগী আনা-নেওয়া হয় দুর্বিষহ।তবুও বৃষ্টির পর শীতল বাতাসে শহরের মানুষ স্বস্তি খুঁজে নেয়।
বর্ষার আগেই জেলা প্রশাসন বৈঠক করে, বাঁধ মেরামত করা হয়, ত্রাণ মজুত রাখা হয়। ইউনিয়ন পরিষদগুলো নৌকা মজুত রাখে, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখে।
কিন্তু বড় ঢল এলে সেই প্রস্তুতি সবসময় যথেষ্ট হয় না। অনেক পরিবার স্কুলের বারান্দা বা রাস্তায় আশ্রয় নেয়। ত্রাণের জন্য ইউনিয়ন অফিসে ভিড় করে।
সব আতঙ্কের মধ্যেও বর্ষা মুন্সীগঞ্জে এক রকম উৎসব।শাপলা-শালুক তোলা, নৌকা সাজানো, বৃষ্টিতে কাদামাখা খেলা, খিচুড়ি রান্না—সবই বর্ষার রঙিন ছবি।গ্রামের উঠোনে বৃষ্টির শব্দে গল্প হয়। বাচ্চারা কলাগাছের ভেলায় ভেসে খালে-বিলে ঘুরে বেড়ায়। নৌকা বাইচের প্রস্তুতি শুরু হয়।
একজন বৃদ্ধা বললেন—“বর্ষা ছাড়া মুন্সীগঞ্জ চিন্তা করা যায়? নদী ছাড়া তো জীবনই নেই!”
বর্ষা মুন্সীগঞ্জের মানুষের কাছে জীবন আর জীবিকার অংশ, বেঁচে থাকার শর্ত। নদীর টানে ভাঙন আছে, আবার নদীর কোলেই শস্য, মাছ, উর্বরতা।
বর্ষা এলে মুন্সীগঞ্জ নতুন করে বাঁচে, আবার কিছুটা হারিয়ে যায়ও। এটাই নদীর জেলার চিরন্তন নিয়তি।
সাব্বির