ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

গ্রামীণ জনপদের পরিশ্রমী যমুনা বালা

বাবু ইসলাম

প্রকাশিত: ১৬:৪৯, ৮ মে ২০২৫

গ্রামীণ জনপদের পরিশ্রমী যমুনা বালা

যমুনা বালা- গ্রামীণ জনপদের অসীম ধৈর্যশীল পরিশ্রমী একজন নারী। চোখে পুরু গ্লাসের চশমা। শে^তশুভ্র বসন। মাথার চুল, চোখের ভ্রু বয়সের ভারে সাদা হয়ে গেছে। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই করলেও এখনো জীবন চলা থেমে নেই। তিনি কাজ করেন। স্বামী, সন্তান, পরিজন সামাল দিয়ে বেত শিল্পে কাজ করে সংসার ধরে রেখেছেন। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার আটঘরিয়া গ্রামে। রায়গঞ্জ উপজেলার আটঘরিয়া, দরবাস্ত ও জয়েনপুর গ্রামের বেত শিল্প বিশেষ করে শীতলপাটি সারাদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। যমুনা বালাসহ শতাধিক নারী কারিগর বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক শীতল পাটিতে ৫শ’ টাকা মজুরি। এক খানা শীতল পাটি তৈরিতে সময় লাগে দুই দিন। অর্থাৎ প্রতিদিনের রোজগার আড়াইশ’ টাকা। শীতল পাটির পল্লী হিসেবে পরিচিত আটঘরিয়া, দরবাস্ত ও জয়েনপুর গ্রামে বাঁশজাত হরেক রকমের পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। তবে এখন প্লাস্টিকের যুগে বেত শিল্পের কদর কিছুটা কমেছে। তবুও ঐতিহ্য বহন করে বেত শিল্প।
যমুনা বালার বয়স যখন ৮, তখন থেকেই শীতল পাটি বুননে হাতেখড়ি। বাবা শ্রীকান্ত সরকার শীতল পাটির কারিগর ছিলেন। তিনি মেয়ে যমুনা বালাকে বিয়েও দিয়েছেন আরেক শীতল পাটির কারিগর শান্তি রাম দের সঙ্গে। কিন্তু নারী হিসেবে স্বামীর সংসারে এসেও, শুধুই ঘরের বউ হতে পারেননি যমুনা বালা। তাকে বেত শিল্পের কারিগর হিসেবে কাজ করে সংসারের ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। ঘরে তার তিন ছেলে নাতি-নাতনি সবই আছে। তবুও থেমে নেই যমুনা বালার কাজ। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করেও তার আয় কম। শহরের নারীরা যমুনা বালার মতো নারীদের চেয়ে কম পরিশ্রম করে বেশি টাকা উপার্জন করে, এ খবর তারা জানে। কিন্তু দরিদ্রতার কষাঘাতে মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়। নতুবা মহাজনের কাছে তার কাজের কোনো মূল্যায়ন হবে না। কাজ পাবে না। গ্রামে নারীরা তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অনেক সময় শক্তি এবং প্রতিরোধের চিত্র দেখায়। বহু গ্রামীণ নারী তাদের পরিবারের দায়িত্বের পাশাপাশি সমাজে পরিবর্তন আনতে কাজ করেন। গ্রামে নারীদের মধ্যে এক ধরনের ঐতিহ্যগত শক্তি ও সহনশীলতা দেখা যায়, যা তাদের জীবনে চলমান সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত।
দেশজুড়ে শুধু নয়- বিশ্বজুড়েই গ্রামীণ জনপদের ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়গুলোতে গ্রামীণ নারীরা ঘর-সংসারের কাজ সামাল দিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষি কাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং কৃষি কাজের বাইরের কাজের মতো বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে, গ্রামীণ নারীরা খুব কঠোর পরিশ্রম করে কিন্তু খুব কম আয় করে।
নারীরা প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হন। কারণ তাদের পুরুষদের মতো জমির মালিকানা দেওয়ার অনুমতি নেই। তারা যা শহরের নারীদের জীবন তুলনামূলকভাবে স্বাধীনতা এবং সুযোগে পূর্ণ। এখানে নারীরা শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র এবং নানা পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পায়। শহরের অবকাঠামো উন্নত হওয়ায় নারীরা কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়। তবে শহুরে জীবনে নারীদের জন্য প্রচলিত প্রতিযোগিতা এবং সাম্প্রতিক সামাজিক চাপও বৃদ্ধি পায়। অনেক শহুরে নারী তাদের পেশাগত জীবন ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করতে চেষ্টা করে, যা অনেক সময় চাপ সৃষ্টি করে। এ ছাড়া শহরের নারীরা সমাজে অনেক বেশি সচেতন এবং তারা নানা সামাজিক আন্দোলন ও অধিকার দাবিতে অংশগ্রহণ করে। যদিও শহর অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের জন্য অধিক সুযোগ তৈরি করেছে, তবে শহুরে সমাজে নারীদের প্রতি বৈষম্য, ধর্ষণ, সহিংসতা এবং শোষণও একটি বড় সমস্যা। শহরের নারীদের জন্য এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো তাদের জীবনকে আরও জটিল করে তোলে।
গ্রামীণ নারীরা বিশেষ করে দরিদ্র এবং নারী উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধাবঞ্চিত।  গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের নারীরা তাদের পুরুষ প্রতিপক্ষের তুলনায় দারিদ্র্যের ঝুঁকি এবং সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগের সম্মুখীন হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদানকে সাধারণত অবমূল্যায়ন করা হয়, কারণ নারীরা অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিমাণে যত্নের কাজ করে যা প্রায়শই অস্বীকৃত থাকে কারণ এটি অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনশীল হিসেবে দেখা হয় না। যদিও কিছু দেশে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক রীতিনীতি মহিলাদের বাড়ির বাইরে কাজ করতে বাধা দেয়, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা পরিবারগুলো বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই মহিলাদের কাজের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল, যার ফলে মহিলাদের জন্য দীর্ঘদিন এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, দারিদ্র্যের নারীকরণ এমন একটি ধারণা যা শহর এবং গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলাদেশে নারীদের জীবন সংগ্রাম এক গভীর এবং প্রেরণাদায়ক অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময় বা স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রতিটি যুগে, প্রতিটি সংস্কৃতিতে নারীরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন এবং শক্তি ও দৃঢ়তার উদাহরণ স্থাপন করেছেন। নারীর জীবন কাহিনী বিভিন্ন পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে ভিন্নভাবে নির্মিত হয়। গ্রাম, শহর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে নারীদের জীবনচিত্র একেক রকম। তাদের সংগ্রাম, আশা এবং নিরাশার কাহিনী প্রতিটি স্থানে একে অপরের থেকে ভিন্ন। কিন্তু এই ভিন্নতাগুলো যেন এক গভীর সাদৃশ্য তৈরি করে, যেখানে নারী তার অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে।

প্যানেল

×