ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

মায়ের জন্য ভালোবাসা

মো. হারুন অর রশিদ হৃদয়

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ৮ মে ২০২৫; আপডেট: ১৬:৪৫, ৮ মে ২০২৫

মায়ের জন্য ভালোবাসা

মা, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখের ডাকটি হলো সম্ভবত মা। মায়া, মমতায় ভরা নামটা যেন প্রত্যেকটি সন্তানের প্রকৃত বিশ্বাস ও আস্থার একটি কেন্দ্রবিন্দু। সবার কাছে সবার মা মহা মূল্যবান থাকে। একটি পরিবারে সবচেয়ে বেহায়া বলতে গেলে মা হয়। এই মা নামক ব্যক্তির কাছে এসে নিউটনের তৃতীয় সূত্রও ব্যর্থ বলে পরিণত হয়। পৃথিবীতে যত রাগ, ক্ষোভ মাকে দেখানো হলেও সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া ঘটে না। নীরবে নিভৃতে শত দুঃখ শাড়ির আঁচলে মুছে সেই মা-ই নামাজ পড়ে মোনাজাত করে সন্তানের মঙ্গল কামনায় অঝোর ধারায়, বৃষ্টি ঝরায়। একটি মা হারা সন্তানই জানে তার তিন বেলা খাবারের রুটিনটি থেমে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন তার মাকে দাফনে মুড়িয়ে কবরস্থ করা হয়েছে। সে জানে রাগ করে খাবার না খেলে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার মানুষটি আর নেই। শীতের রাতে অলসতায় পেটে ক্ষিদে রেখে ঘুমাতে চাওয়া সন্তানদের ঠান্ডা পানিতে হাত ধুয়ে খাবার খাইয়ে দেওয়া মায়েদের যেন এক বিরাট সুখ নিহিত থাকে। আমার মনে পড়ে রাগ করে নাশতা না খেয়ে বেরিয়ে পড়ায়, মা ছুটে গিয়েছিল (৩.৫) সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে। মাও হয়তো জানতেন না কত না শলার মুঠি না খেতে চাওয়ায় নষ্ট হয়েছিল এই পিঠা। সন্তানের কাছে মায়েদের চাহিদা থাকে না। জীবিত থাকা অবস্থায় মা নামক ব্যক্তিটি পৃথিবীতে একজনের কাছেই শুধু চাইতে থাকে, ‘তার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। চোখের সামনে মা নামক প্রাণীটি থাকলে তার কদর কতটুকু বোঝা যায় না। সন্তানদের রেখে মা যদি পাঁচটি দিনের জন্যও কোথাও বেড়াতে যায়, তখন মনে হয় এই সাজানো-গোছানো ঘরের যেন মূল খুঁটিটি নড়বড়ে। প্রতি মুহূর্তে শঙ্কা জাগে মনে, এই বুঝি ভাঙল মোর ঘর। বাবার সঙ্গে নিত্যদিনের খুনসুটিতে মা প্রত্যেকবারই বলে যেত, মুই চললাম মোর সন্তানদের নিয়ে, তুমি থাকো তোমার সংসারে। কখনো মা যেন ভুলতেই চাইতেন না যে তিনি একাও বাস করতে পারেন। সন্তানের যত ন্যায়, অন্যায়-আবদারগুলো মিটাতে গিয়ে কত মা যে জীবন দিয়েছিলেন অকাতরে। বাইরে থেকে যত রাতেই ফিরতাম বাড়িতে, ঘুমাত না মা, প্রতিদিন এসে দেখতাম বসে আছে পিঁড়িতে। দুঃস্বপ্ন দেখে যত রাতেই উঠতাম জেগে সবার আগে মা হন্যে হয়ে সান্ত্বনা দিত হাত বাড়িয়ে। মায়েদের ঋণ যে শোধ হওয়ার নয়। তবুও কেন মায়েদের বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা হয়। অধিক সন্তান থাকলেও দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়াতে মা করেনি ভাগাভাগি। সেই মাকে রাখার দায়িত্বে দুই ভাইয়ের হয় মারামারি। আমরা সবাই বলে বেড়াই আমার আল্লাহ আমার দিকে ফিরে তাকায় না। কিন্তু আমাদের সামনে থাকা জীবন্ত এই বরকতের ভাণ্ডার থেকে আমরা লুটে নিতে পারি না। মায়েরা এমন কেন জন্ম নিয়েছি কালো, কিন্তু মা সবার কাছে বলে বেড়ায় আমি নাকি সবার থেকে ভালো। প্রবাসে থেকে পরিবারের সকলের বড় বড় আবদার রক্ষা করতে পারলেও পারিনি সেই দুঃখিনী মায়ের ছোট্ট আবদারখানা রাখতে। মা যে শুধুই খুব করে চাইত আমি যেন ফিরে যাই তার কোলে। মায়ের মনে কতই না আঘাত দিয়ে যাই প্রতিদিন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। কিন্তু মা যে ব্যতিক্রমী, আঘাতগুলো রাখেই না তার এই ছোট্ট মনে। আমাকে আঘাত করে দ্বিগুণ কষ্টে কাঁদতে দেখেছি মাকে। অসুখ হলে বলত না মা মুখ ফুটে, ভাবতেন তার জন্য খরচ না বেশি হয়ে ওঠে। বন্ধুর মতো মিশে যেত মা আমার সঙ্গে, ভাবতেন আমার সন্তান মানসিক যন্ত্রণায় যেন বেড়ে না ওঠে। আমাদের ছেড়ে খাবার খাওয়া এটা যেন মায়ের যুদ্ধে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ওঠে। যে মায়ের জীবনে ঘুম ছিল একটা রুলে, সেই মা নাকি আমাকে পেয়ে ঘুম গিয়েছে ভুলে। রাতের পর রাত ঘুম না গিয়েও হয়নি বিরক্ত, সেই আমি আজ বড় হয়ে বলি, মা তুমি বিরক্ত। আমাকে পেয়ে যেই মা নিজের জন্মদাতা পিতা মাতাকে ভুলেছে, সেই আমি আজ নতুন বউ পেয়ে রেখে আসি মাকে, বৃদ্ধাশ্রমেতে। আমার মতো হতভাগা নাইরে দুনিয়াতে, মায়ের মতো এত বড় ধন হারাই নিজ হাতে।

 

নাজনীন বেগম

প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের রবিবারে বিশ্ব মা দিবস পালন করা হয়। যদিও সর্বংসহা জননীর জন্য বিশেষ কোনো দিন প্রয়োজনই পড়ে না। প্রতিক্ষণের সবচেয়ে নিকটতম মানুষটিই মায়ের আসনে অধিষ্ঠিত, অলঙ্কৃত। পৃথিবীর অনন্য মাধুর্যময় শৌর্যটিই মা। দশ মাস দশ দিন গর্ভ ধারণ করা মায়ের ঋণ নাকি আজন্ম অপরিশোধ্য মহিমান্বিত রূপের আধার। যার কোনো বিনিময় কিংবা ব্যত্যয় অমূলক এক ভাব কল্পনা। নেপোলিয়ান উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেনÑ আমাকে একজন মা দাও আমি একটি সুন্দর জাতি উপহার দেব। যুগ-যুগান্তরের বরমাল্য। যা আজও সময়ের আবেদনে এক অক্ষয় ঐশ্বর্য। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে উচ্চারিত শব্দটি ‘মা’। যার আবেদন, নিবেদন, সমর্পণে একটি সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল জাতি একতাবদ্ধ হয়। আর বিশ্ব ইতিহাসে পরিবার হিসেবে প্রথম সংগঠিত হয় মাতৃতান্ত্রিক। মায়ের অভাবনীয় এক শুভযাত্রা। যখন অবধি পারিবারিক আর সামাজিক বন্ধনের সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল কোনো বাতাবরণ তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন অপেক্ষমাণ থাকতে হয়েছে, বন্য, বর্বর থেকে আদিম মানুষদের পিতৃপরিচয় জানতে। অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিবাহের কারণে পিতার পরিচয় জানা ছিল এক অজানা বিস্ময়। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে জননীর পরিচয় সামনে আসতে সৃষ্টির সেরা মানুষকে অপেক্ষাও করতে হয়নি বলে প্রাচীন বিজ্ঞ, পণ্ডিতদের বদ্ধমূল ধারণা। বন্য, বর্বর আর আদিম সমাজের পালাক্রমে কোনো এক সময় ‘পরিবার’ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান স্বমহিমায় আবির্ভূত হওয়া জগৎ সৃষ্টির, আর এক নবতর আঙিনা। পিতৃত্বের পরিচয় চিহ্নিত হওয়াই শুধু নয় বরং জন্মদাত্রী মাকে চলে যেতে হয় আড়ালে, আবডালে, অন্তরালে। শুধু কি তা-ই, ঐতিহাসিক পরাজয় বরণ করাও ছিল সময় আর যুগের অপরিহার্য চাহিদা। তেমন পরাভূত, দুঃসময়কে অতিক্রম করা আর সম্ভবই হয়নি। তবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপহার দিয়ে নারীর যে ঐতিহাসিক বরমাল্য আজও তা সমাজ সভ্যতার অবর্ণনীয় শৌর্য। শুধু কি মাতৃত্বের মহিমা? সমাজ সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে আদিম সমাজ থেকে কৃষি অর্থনীতির বীজ বপন করা সবই নাকি চিরস্থায়ী ধৈর্য, সহ্যের প্রতীক মায়েদের হাত ধরেই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা জানি অতি আদিম অবস্থায় খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে অপেক্ষাকৃত শক্তিমান পুরুষ বন থেকে বলাঞ্চল ঘুরে যে ফলমূল নিয়ে আসত তাই আদিম মানুষের আহারের সংস্থান। তখন অবধি আগুনের আবিষ্কারই হয়নি। নব্য প্রস্তরের যুগে পাথরের সঙ্গে পাথরের ঘর্ষণে আগুনের নব অভ্যুদয় বিশ্ব ইতিহাসের আর এক নিয়ামক শক্তি, পথ  চলা তো বটেই। ঘুরে বেড়ানো সময়গুলোতে আদিম বন্য মানুষ যা কুড়িয়ে আনত সেটা শুধু ভক্ষণ করাই নয়, বরং সেই বীজ থেকে নতুন গাছপালা জন্মানোও সভ্যতা সূর্যের নতুন রশ্মির চলমান প্রক্রিয়া। তাই কৃষি সভ্যতার বীজ বপনেও নারীর অবিস্মরণীয় কর্মযোগ সৃষ্টি সুখের নব উল্লাসে ছন্নছাড়া, আদিম মানুষের নতুন পথের সন্ধান দিল। তাই জননী মানেই শুধু দিনক্ষণ নয় সৃষ্টির প্রারম্ভিক লগ্ন থেকেই এক অপরাজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির ভূমিকায় অজেয়, অবিনাশী বিস্ময়কর অধ্যায়। আজও মায়েদের যথার্থ ভূমিকা দেশ ও জাতিকে পরম্পরায় সামনের দিকে ধাবিত করছে। মায়ের শৌর্য, বীর্য যেমন অভাবনীয় এক সম্ভার একই ভাবে সন্তানের জন্য জন্মদাত্রী মায়ের বিকল্প অন্য কিছুতেই নয়। মা দিবসের তাৎপর্যে এমন সব কীর্তিময়, সময়োচিত কর্মপ্রবাহ কোনো হিসাব নিকাশের মধ্যেই পড়ে না। যা চিরন্তন, শাশ্বত শিখায় নিয়ত প্রজ্বলিত। তাকে আসলে মাতৃত্বের বন্ধন ছাড়া অন্য কিছুতে আটকানো যায় না। নির্দিষ্ট দিবসও তেমন সম্পদকে যথার্থ মান্যতা দিতে পিছু হটবে। তবুও দিবসটি আসলে সন্তানরা নতুন অনুভবে, নব আলোকে মাকে স্মরণ করে, বরমাল্য দেয়। ‘মা’ শব্দটি নিত্যদিনের অভ্যাস সন্দেহ নেই, কিন্তু বিশেষ দিবসেও তো আড়ম্বর আর উৎসব আয়োজনের ঘাটতি হতে না দেওয়াও মাতৃহৃদয়ের প্রতি পরম নিবেদনের স্তুতিতে অর্ঘ্য সমর্পণও সন্তানদের জন্য বিশেষ মর্যাদায় সামনে এসে যায়। আনন্দ, আপ্যায়নে ‘মা দিবস’কে স্মরণে, বরণে আপ্লুত আর আবৃত করে রাখতে সন্তানরা যে মাত্রায় আবেগ-উৎকণ্ঠায় অপেক্ষমাণ থাকে তাও পরম এক মহামূল্যবান সময়ের স্রোতধারা। তবে আধুনিক সমাজে মায়েদের বিপরীত প্রদাহ ও সমাজ সংস্কারকে নির্বিঘ্নে চলতে দেয় না। কোনো এক সময় একাকিত্বের যন্ত্রণায় ছটফট করাও যেন যাপিত জীবনের ঘানি টানা। মায়ের এক জনমের সাধনায় সন্তানদের যে মানবিক, স্বাভাবিক  জীবন তাও অমূল্য রতন। যাকে হেলাফেলা করাই চরম অধোগতি।  হীনম্মন্যতায় সন্তানের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে বারবার হোঁচট খেতে হয়। সময় থাকতে শুধু মায়ের দাম দেওয়াই নয় বরং নিজের প্রতি অপরিহার্য দায়বদ্ধতাও এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। ইসলাম ধর্মে মাকে যে উচ্চাসন বসায় তাও আধাত্ম্য চেতনার পরম আবেদন। ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ সেভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও পূজ-পার্বণে মাকে দেবীর আসনে বসায়। যেখানে মাতৃহৃদয়ের অভাবনীয় শৌর্য ছাড়াও মায়ের নিত্য কর্মযোগেরও বিশেষ বিশেষ আরাধনায় দেবী প্রতিমা যেন মাতৃমহিমার বিভিন্ন রূপের বহুমাত্রিক সংযোজন। তাই গর্ভধারিণী সর্বংসহা জননী যেন প্রতিনিয়ত, অনুক্ষণে চারপাশে ঘিরে থাকার চেয়ে সন্তানদের মঙ্গল অন্য কিছুতেই নয়। নিজ দেশের গৌরবেও থাকে মাতৃভূমি। যা মায়ের মতোই সন্তান বাৎসল্যে আকুল হয়, নিবেদনের অর্ঘ্যে সমর্পিত হয়। তার পরও মহান মা দিবসে শতকোটি মায়ের জন্য পরম শ্রদ্ধা আর সম্মান-মর্যাদার বরমাল্য। 

প্যানেল

×