
ছবি: প্রতীকী
প্রতিদিনের জীবনে আমরা অনেকেই অতিরিক্ত চিন্তা বা ওভার থিংকিংয়ের শিকার হই। একটি সমস্যা নিয়ে বারবার ভাবা, তার সম্ভাব্য ক্ষতি ও কারণ ঘুরে ফিরে মনে আনা, অথচ সেই সমস্যা সমাধানের কোনও চেষ্টা না করাই মূলত ওভার থিংকিং বা রিউমিনেশন। এটি শুধু মানসিক অস্থিরতা বাড়ায় না, বরং দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিষণ্নতা, উদ্বেগ এমনকি অন্যান্য মানসিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে একটি "ডিফল্ট মুড নেটওয়ার্ক" কাজ করে, যা স্টিমুলাস ছাড়া নানা চিন্তা তৈরি করে। এই নেটওয়ার্কটি যদি অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে, তাহলে ব্যক্তি বারবার অজান্তেই নেতিবাচক চিন্তার জালে আটকে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের ওভার অ্যাক্টিভ ব্রেইনের কারণে মানুষ বেশি আনহ্যাপি থাকে এবং নেতিবাচক দিকেই মনোযোগ দেয়। এমনকি দশটি প্রশংসার মধ্যে দুটি সমালোচনা পেলেও মন পড়ে থাকে সেই দুটি মন্তব্যেই।
ওভার থিংকিং সম্পূর্ণরূপে অস্বাভাবিক নয়। জীবনের নানা চাপ, সিদ্ধান্তহীনতা বা অনিশ্চয়তা থাকলে মানুষ কিছুটা ওভার থিংক করে। তবে যখন তা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয় এবং চিন্তাগুলো একই ধরনের নেতিবাচক আবর্তে ঘুরপাক খায়, তখন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই অভ্যাসটি একসময় ব্যক্তিকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে।
অনেক সময় ওভার থিংকিংয়ের পেছনে মানসিক রোগও কাজ করে। ডিপ্রেশন, জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ওসিডি, এডিএইচডি, ইটিং ডিসঅর্ডার কিংবা মাদক ব্যবহারের অভ্যাস এসব রোগের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া অতীতের কোনো ব্যর্থতা, সম্পর্কের কষ্ট, অপরাধবোধ বা ভাগ্য নিয়ে হতাশা থেকেও মানুষ বারবার একই চিন্তায় ডুবে যেতে পারে।
এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কিছু কার্যকর কৌশল রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রথমেই বুঝতে হবে যে আপনি ওভার থিংক করছেন এবং এটি আপনাকে কোনো উপকার করছে না। তখন নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হবে, এই চিন্তা অপ্রয়োজনীয়, অকার্যকর। অনেকেই উচ্চস্বরে নিজেকে বলেন, “আমি এখন রিমিনেট করছি, এটা থামাতে হবে।” এইভাবে চিন্তার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
চিন্তা থামানোর জন্য অনেকেই কিছু শারীরিক বা মনোযোগ-ভিত্তিক কাজ করেন। যেমন গান শোনা, গোসল করা, হেঁটে বের হওয়া, ব্যায়াম করা ইত্যাদি। এতে মন অন্যদিকে যায় এবং চিন্তার প্রবাহে বাধা পড়ে। অনেকে আবার প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় রাখেন, যেটাকে বলেন ‘ওয়ারি টাইম’। সারাদিনের দুশ্চিন্তা জমিয়ে রেখে নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলোর বিশ্লেষণ করলে মন হালকা হয়, আবার সারাদিন অকারণে চিন্তা করাও কমে যায়।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, অনেক সময় আমরা সবকিছু নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি—‘আমার সাথেই কেন এমন হয়’, ‘আমি কেন ভালো হতে পারছি না’ ইত্যাদি। এই 'মি লুপ' থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যদের অনুভূতি, জীবন বা সমস্যার দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত। এতে নিজের সমস্যাকে তুলনামূলকভাবে সহজ মনে হয় এবং মনোভাবে ভারসাম্য আসে।
চিকিৎসাবিদ্যায় প্রমাণিত কিছু পদ্ধতি যেমন মাইন্ডফুলনেস ও কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপিও ওভার থিংকিং কমাতে কার্যকর। মাইন্ডফুলনেস চর্চার মাধ্যমে মানুষ বর্তমান মুহূর্তে থাকতে শেখে, আর কগনিটিভ থেরাপির মাধ্যমে বিমূর্ত চিন্তাগুলোকে বাস্তব সমস্যায় রূপান্তর করে তার সমাধান খোঁজা হয়। এতে করে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে নেতিবাচক ভাবনার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে, যদি ওভার থিংকিং কোনো মানসিক রোগের উপসর্গ হয়ে থাকে, তাহলে শুধু ঘরোয়া পদ্ধতিতে কাজ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই সমস্যা আমাদের সমাজে অনেকের মধ্যেই দেখা যায়, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ জানেন না কীভাবে এটি মোকাবিলা করবেন। তাই সচেতনতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে নিজের ও আশেপাশের মানুষের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা জরুরি।
ভিডিও দেখুন: https://youtu.be/anYlLt4cEHw?si=g9cL_8cNjrry9dl0
এম.কে.