
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভুল। আর এতেই শেষ হয়ে গেল ২৬০টি জীবন। আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের পথে উড়তে শুরু করেছিল এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার। কিন্তু উড়াল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে বিমানটি। ভারতের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (AAIB) প্রকাশিত একটি প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গত ১২ জুন আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করা বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারটি উড়তে না উড়তেই উচ্চতা হারাতে শুরু করে। শনিবার রাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি ছিল গত এক দশকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা।
তদন্ত প্রতিবেদনে ইঞ্জিনের জ্বালানির কাটঅফ সুইচের অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বোয়িং বা ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেকট্রিক (GE)-এর বিরুদ্ধে আপাতত কোনো দায়ভার আরোপ করা হয়নি।
পাইলটের বিভ্রান্তি, ভুল বোঝাবুঝি আর বিপর্যয়
প্রতিবেদন অনুযায়ী, উড়োজাহাজটি উড়াল দেওয়ার পরপরই তার দুই ইঞ্জিনের জ্বালানির সুইচ ‘রান’ অবস্থা থেকে প্রায় একই সময়ে ‘কাটঅফ’ অবস্থায় চলে যায়। এতে ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে শক্তি হারাতে শুরু করে বিমানটি। এই মুহূর্তে ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারে ধরা পড়ে এক পাইলট অপর পাইলটকে জিজ্ঞেস করছেন, “তুমি কেন জ্বালানি কেটে দিলে?” জবাবে অন্য পাইলট বলেন, “আমি করিনি।”
তবে কোন পাইলট এই প্রশ্ন করেছেন, বা কে 'Mayday, Mayday, Mayday' সংকেত দিয়েছেন—তা প্রতিবেদনে পরিষ্কার করা হয়নি।
বিমানটির ক্যাপ্টেন ছিলেন ৫৬ বছর বয়সী সুমিত সাবারওয়াল, যিনি এয়ার ইন্ডিয়ার একজন প্রশিক্ষকও ছিলেন। তাঁর উড়োজাহাজ চালানোর মোট অভিজ্ঞতা ছিল ১৫ হাজার ৬৩৮ ঘণ্টা। সহকারী পাইলট ছিলেন ৩২ বছর বয়সী ক্লাইভ কুন্দর, যাঁর অভিজ্ঞতা ছিল ৩ হাজার ৪০৩ ঘণ্টা।
কেন সুইচ কাটা পড়ল, উত্তর মিলছে না
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইট চলাকালে ভুলক্রমে জ্বালানির সুইচ ‘কাটঅফ’ অবস্থায় যাওয়া প্রায় অসম্ভব। একজন মার্কিন বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্থনি ব্রিকহাউজ বলেন, “যদি এটি পাইলট-সৃষ্ট হয়ে থাকে, তবে কেন তিনি এমন করলেন?” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুইচ দুটি মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে বন্ধ হয়েছে। এমন দ্রুত সময়ের ব্যবধানে দুটি সুইচ বন্ধ করা সচেতন কোনো পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উড়োজাহাজ যখন গেটের কাছে আসে বা কোনো জরুরি পরিস্থিতি (যেমন ইঞ্জিনে আগুন) তৈরি হয় তখনই সাধারণত এই সুইচ বন্ধ করা হয়। কিন্তু ওই ফ্লাইটে এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতির প্রমাণ মেলেনি।তবে ঘটনাস্থলে উদ্ধার হওয়া বিমানের উভয় জ্বালানি সুইচ ছিল ‘রান’ অবস্থায় এবং ইঞ্জিন দুটি আবার চালু হওয়ার চেষ্টা করেছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
টাটার চ্যালেঞ্জ আর ক্রমবর্ধমান চাপ
২০২২ সালে ভারত সরকার থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার পর থেকে টাটা গ্রুপ সংস্থাটির সংস্কারে জোর দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অভিযানে বড় একটি ধাক্কা। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে এয়ার ইন্ডিয়া তীব্র নজরদারির মুখে রয়েছে।
সম্প্রতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাভিয়েশন সেফটি এজেন্সি জানায়, তারা এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করবে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস তাদের একটি এয়ারবাস A320 বিমানের ইঞ্জিন পার্টস সময়মতো পরিবর্তন না করে নথি জালিয়াতি করেছে।
ভারতের অ্যাভিয়েশন রেগুলেটরও এয়ার ইন্ডিয়াকে সতর্ক করেছে, তিনটি এয়ারবাস বিমানে ইমারজেন্সি স্লাইড পরীক্ষা সময়মতো না করার কারণে। জুন মাসে আরও একবার প্রতিষ্ঠানটির পাইলট ডিউটি টাইমিং নিয়েও গুরুতর ‘নিয়ম লঙ্ঘনের’ অভিযোগ ওঠে।
ভারতের উড়োজাহাজ শিল্প ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
দুর্ঘটনার তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা এএআইবি। নিয়ম অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন এবং এক বছরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার ও বিশ্লেষণের পরই এই প্রতিবেদনের খসড়া তৈরি হয়েছে। এতে বিমানটির উচ্চতা, গতি ও পাইলটদের শেষ কথোপকথনের তথ্য পাওয়া যায়।
ভারত সরকার বর্তমানে নিজ দেশকে একটি বৈশ্বিক এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। তাদের লক্ষ্য—দুবাইয়ের মতো একটি কর্মসংস্থানভিত্তিক এয়ার হাব গড়ে তোলা, যা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের বড় অংশ পরিচালনা করতে পারে।
এয়ার ইন্ডিয়ার বিধ্বস্ত বিমানের এই প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যার উত্তর এখনো মিলেনি। কীভাবে ঘটল এমন বিভ্রান্তি, কেনই বা সচল সুইচ বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই—এই রহস্যের জট এখনই খুলছে না। তবে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের উড়োজাহাজ শিল্পকে নিরাপত্তা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সূত্র:https://tinyurl.com/3wdfhm3k
আফরোজা