
গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করা গণভবন বিভিন্ন সময় হয়ে উঠেছিলো দমন-পীড়ন, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের একটি প্রতীকি কেন্দ্র। জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে গণভবনে কী ঘটেছে, সেই রুদ্ধদ্বার নাটকের করুণ চিত্র উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল হওয়া অভিযোগপত্রে। উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের অনুরণন, যেখানে একদিকে ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল ধ্বনি, অন্যদিকে রাষ্ট্রশক্তির নিরঙ্কুশ বলপ্রয়োগ।
গেল দেড় দশকে হত্যা, নির্যাতন, গুমসহ নানা ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল গণভবন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশি-বিদেশি সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে এই গণভবনকে ঘিরে বহু নৃশংস ঘটনার বর্ণনা।
১৪ জুলাই ২০২৪, গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করেন। যার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ। যদিও এই শিক্ষার্থী জাগরণকে গুরুত্ব দেয়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব।
এরপর ছাত্রলীগ বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর সংঘবদ্ধ হামলা চালায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার সেই বক্তব্যকে হত্যা ও নিপীড়নের উসকানি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, রুয়ান্ডা গণহত্যার মতোই ওই বক্তব্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে মানবতা-বিরোধী অপরাধ সংঘটনে প্ররোচিত করেছিল।
১৭ জুলাই গণভবন থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে শোকের ভাষণ এলেও বাস্তবে শুরু হয় নির্মম নিপীড়ন। ঢাকার যাত্রাবাড়ি, রামপুরা, উত্তরা, সায়েন্স ল্যাবসহ সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। শহীদের কাতারে যোগ দেয় দুই শতাধিক ছাত্রজনতা। কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর, ২৩ জুলাই ২০২৪, গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকে ছাত্রদের প্রতি "দেখামাত্র গুলি" নীতির ঘোষণা দেন ওবায়দুল কাদের।
পরবর্তী দিনগুলোতে শহীদ পরিবারের প্রতি অভিনয়মূলক সহানুভূতির মাধ্যমে নানা নাটক মঞ্চস্থ হয় গণভবনকেন্দ্রিকভাবে। তবে ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা হঠাৎ বললেন, “গণভবনের দরজা খোলা। যখনই এই আন্দোলনকারীরা কথা বলতে চায়, আলোচনা করে সমাধান করতে চায় আমি তাদের সাথে নিজেই বসতে রাজি।”
কিন্তু পর্দার অন্তরালে ছিল ভিন্ন এক বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অভিযোগপত্রে ৪ আগস্টের দুপুরে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সাক্ষাতের কথা উঠে এসেছে, যেখানে তাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেয়া হলেও আওয়ামী নেতাদের বিরোধিতায় তা নাকচ হয়।
অভিযোগপত্রে আরো উঠে এসেছে ৪ আগস্ট রাতের গোপন বৈঠকের কথা। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, আইজিপি, র্যাব ডিজি এবং সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে আলোচনা হয় পরদিনের ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচি দমন নিয়ে।
বৈঠকে সেনাবাহিনীর গুলিচালনার প্রস্তাব দিয়ে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী বলেন, “সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোক মেরে ফেললেই বিক্ষোভ দমন হয়ে যাবে।”
৫ আগস্ট সকালে শেখ হাসিনা শেষবারের মতো সেনাপ্রধানদের ডেকে এনে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। পুলিশের কাজের প্রশংসা করে সেনাবাহিনীর প্রতি অসন্তোষও প্রকাশ করেন।
তবে বাস্তবতা বদলাতে থাকে দ্রুত। কারফিউ ভেঙে লক্ষাধিক জনতা রাজপথে নেমে এলে সেনা কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো এবং গণভবনেই কবর দিয়ে দাও।”
এক পর্যায়ে শেখ রেহানা শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরেন। সামরিক কর্মকর্তারা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন। জয়ের পরামর্শেই শেষ পর্যন্ত গুম, খুন, নির্যাতনের কালিমা মাথায় নিয়ে গণভবন থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
আফরোজা