
ছবি: জনকণ্ঠ
যশোরের মণিরামপুরে হাত-পা ছাড়াই জন্ম নেওয়া সেই অদম্য মেধাবী লিতুন জিরা’র চমক জাগানিয়া সাফল্যে তাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে যান মণিরামপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া এই ছাত্রীর বাড়িতে শুক্রবার ফুল আর মিষ্টি নিয়ে হাজির হন ইউএনও নিশাত তামান্না। কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়ে নিজ হাতে মিষ্টিমুখ করান। একইসাথে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হবে বলেও জানান। ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে লিতুন জিরা জানায়, সে আরও ভালভাবে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হতে চায়।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এসএসসি’র ফলাফলে লিতুন জিরা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। হাত-পা ছাড়াই জন্ম নেওয়া থুতনি দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
একের পর এক পরীক্ষায় অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে লিতুন জিরা মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ভবিষ্যতে এই মেধাবী ও লড়াকু সন্তান সমাজের পিছিয়ে পড়া ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। মণিরামপুর উপজেলার গোপালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় লিতুন জিরা।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সাতনল খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান ও জাহানারা বেগম দম্পতির দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছোট লিতুন জিরা। বড় ছেলে ঢাকার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। লিতুন জিরা পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা) ও জেএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর, প্রাথমিকে বৃত্তি লাভ, শ্রেণির সেরা শিক্ষার্থীর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চায়ও রেখেছেন চমক জাগানো অবদান। লিতুন জিরার একাগ্রতা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমেও স্বীকৃতি পেয়েছে সে।
বাবা হাবিবুর রহমান জানান, তিনি গণমাধ্যম কর্মীসহ প্রশাসনের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। সবাই যার যার অবস্থান হতে বরাবরই সহযোগিতা করেছেন লিতুন জিরাকে। লিতুন জিরার মা জাহানারা বেগম জানান, তিনিও কৃতজ্ঞ। সকলকে বরাবরের মতো পাশে থাকার অনুরোধ তার।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিশাত তামান্না বলেন, প্রশাসন সব সময় লিতুন জিরার পাশে থাকবে। একাগ্রতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব কিছু অর্জন করা যায়—তার নজির স্থাপন করেছে লিতুন জিরা। তিনি লিতুন জিরার জিপিএ-৫ খবরে খুবই খুশি হয়েছেন। জেলা প্রশাসক স্যারও তার সাফল্যে খুশি হয়েছেন। অচিরেই লিতুন জিরাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে সংবর্ধিত করা হবে বলেও তিনি জানান।
জানা যায়, অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে বলিয়ান হয়ে সব বাধা টপকে গিয়ে সমাজের ৮/১০ জন প্রতিভাবান স্বাভাবিক শিশুর মতোই এগিয়ে চলেছে লিতুন জিরা। বরং এক্ষেত্রে স্বাভাবিক শিশুর চেয়েও দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলেছে সে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পরপর দুই বছর লিতুন জিরা উপজেলা পর্যায় মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রচনা প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন, একই সালে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল অর্জনসহ একই বছরের ৪ জানুয়ারি লিতুন জিরা খুলনা বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পায়।
লিতুন জিরার মা জাহানারা বেগম আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, জন্মের পর মেয়ে লিতুন জিরার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় অনেক রাত চোখের পানিতে ভাসিয়েছেন। যার দুই হাত-পা নেই, সেই মেয়ে বড় হয়ে কিইবা করতে পারবে—এমন অজানা শঙ্কায় আৎকে উঠতেন তিনি। বড় হওয়ার সাথে সাথে মেয়ের পড়া-লেখার প্রবল আগ্রহ এবং মেধার স্বাক্ষরে সেই শঙ্কা আজ আশার আলোয় রূপ নিয়েছে তার কাছে।
বাবা কলেজ শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি যে কলেজে চাকরি করেন, দীর্ঘ ১৯ বছরেও সেটি এমপিওভুক্ত হয়নি। তারপরও ছেলে-মেয়েদের কখনো অভাব বুঝতে দেননি। হাঁটাচলা করতে না পারা লিতুন জিরার সেই শিশু বয়স থেকে কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়ে ঝড়-বর্ষা মাথায় নিয়ে হুইলচেয়ারে করে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন তিনি।
এসএসসিতেও সে প্রত্যাশিত ফলাফল পেয়েছে। এখন কলেজেও তাকে প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই করতে হবে। লিতুন জিরা ভবিষ্যতে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন।
শহীদ