
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকার দেইর আল-বালাহ শহরে বৃহস্পতিবার সকালে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে সাহায্যের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইমান আল-নৌরির দুই সন্তান নিহত এবং আরেক সন্তান গুরুতর আহত হয়েছে।
৩২ বছর বয়সী ইমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই বছরের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান সিরাজ বৃহস্পতিবার সকালে ক্ষুধায় কেঁদে উঠেছিল। তখন তার ১৪ বছর বয়সী চাচাতো বোন সানা রাজি হয় তাকে ও তার দুই বড় ভাই ওমর (৯) এবং আমির (৫)-কে আলতায়ারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তখনও বন্ধ ছিল, তাই তারা রাস্তায় বসে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
ইমান বলেন, "আমি ছুটে যাই ঘটনাস্থলে। দেখি আমার সন্তানদের ও ভাগনিকে একটি গাধার গাড়িতে করে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, কারণ আশপাশে কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই।"
হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যায় আমির ও সানা। ওমরকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও রক্তের অভাবে প্রাণে বাঁচানো যায়নি। আর সিরাজের অবস্থা গুরুতর – তার মাথায় রক্তপাত, একটি চোখ হারিয়েছে এবং মস্তিষ্কে বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়েছে।
ইমান বিলাপ করে বলেন, "ওরা কী দোষ করেছিল? শুধু ছোট্ট একটা খেলনা পেলেই খুশি হতো। ওরা তো কেবল শিশু ছিল!"
সিরাজ এখনও বেঁচে আছে, তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তারা তাকে চিকিৎসা দিতে অক্ষম।
হামলার সময় ক্লিনিকটি খোলেনি। প্রজেক্ট হোপ নামের একটি মার্কিন সাহায্য সংস্থা ওই ক্লিনিক পরিচালনা করে। সংস্থার মুখপাত্র জানান, ক্লিনিক খোলার আগে বহু নারী ও শিশু সেখানে উপস্থিত হয়েছিল পুষ্টিসামগ্রী ও অন্যান্য চিকিৎসা নিতে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন পুরুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে এবং কাছাকাছি নারীরা ও শিশুদের একটি দল বসে আছে। হঠাৎ এক বিস্ফোরণে চারদিক ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
ডা. মিথকাল আবুতাহা জানান, হামলায় ১৬ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১০ জন শিশু ও ৩ জন নারী। তিনি বলেন, “এই ক্লিনিকটি জাতিসংঘ স্বীকৃত ও সুরক্ষিত মানবিক স্থাপনা। এখানে সামরিক হামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা একটি "হামাস সন্ত্রাসী"কে লক্ষ্য করে হামলা চালায় এবং দুঃখপ্রকাশ করেছে "অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের" ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য। তবে ঘটনাটি তদন্তাধীন বলে জানিয়েছে।
প্রজেক্ট হোপ এই হামলাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে।
গাজার খাদ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। ইমান বলেন, “আমার স্বামী হাটিম নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে খাবার বা আটা আনতে যান। আমরা নিজেরাই খাবার দিতে পারি না, তাই বাচ্চারা প্রায়ই ক্লিনিকে যেত পুষ্টিসামগ্রী নিতে।”
ইসরায়েল মার্চ মাসে গাজায় পুরোপুরি সাহায্য বন্ধ করে এবং হামাসের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান শুরু করে। যদিও মে মাসে আংশিকভাবে সাহায্য প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, কিন্তু এখনও চরমভাবে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির সংকট রয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, গাজা জুড়ে হাজার হাজার অপুষ্ট শিশু রয়েছে এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন শিশু এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। বড়দের মধ্যেও অপুষ্টির হার বাড়ছে, যা আগে দেখা যায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে সাহায্যের আশায় ক্লিনিক বা খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে গেলে মানুষ প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি গুলিতে নিহত হচ্ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এমনভাবে নিহত মানুষের সংখ্যা এখন ৭৯৮, যার মধ্যে ৬১৫ জন গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (GHF) পরিচালিত কেন্দ্রের আশেপাশে মারা গেছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, কিছু বেসামরিক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বলেছে তারা "জনগণের সঙ্গে সংঘাত কমানোর" চেষ্টা করছে।
ইমান বলেন, "যারা প্রতিদিন যুদ্ধবিরতির কথা বলে, তারা কোথায়? আমরা বোমায় মরেছি, গুলিতে মরেছি, ক্ষুধায় মরেছি – আর কী বাকি?" তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “এই যুদ্ধবিরতির কোনো মানে নেই আমার জন্য। আমার সন্তানরা তো আর ফিরে আসবে না।”
সূত্রঃ বিবিসি
নোভা