
ছবি: সংগৃহীত (মারাঠিভাষীদের প্রতি ‘অবিচারের’ প্রতিবাদে অংশ নেওয়ায় মুম্বাইয়ে নারী গ্রেফতার)
ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রে ভাষা ও আঞ্চলিক পরিচয় ঘিরে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা উত্তেজনা এবার সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত থেকেই শুরু এই বিতর্ক।
এপ্রিল মাসে মহারাষ্ট্র সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, রাজ্যের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষা মারাঠির পাশাপাশি তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি ভারতের জাতীয় শিক্ষা নীতির (NEP) আওতায় নেওয়া হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের তিনটি ভাষা শেখার কথা বলা হয়েছে।
তবে এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে তীব্র বিরোধিতায় নামে নাগরিক সমাজ, ভাষা অধিকারকর্মী এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা। তাদের অভিযোগ, হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো মহারাষ্ট্রও ভাষাগত ভিত্তিতে গঠিত। এখানকার জনগণের সঙ্গে স্থানীয় ভাষা মারাঠির গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, এবং সেটি যে কোনো পরিবর্তনের চেষ্টাকে হুমকি হিসেবে দেখা হয়।
বিশেষ করে, হিন্দিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে হিন্দি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা অন্যান্য রাজ্যে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের আশঙ্কা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো থেকে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের খোঁজে মহারাষ্ট্রে আগত মানুষের স্রোত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অভয় দেশপান্ডে বলেন, ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর এসব উদ্বেগ আরও বেড়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতারা হিন্দিকে গুরুত্ব দিয়ে একাধিক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
চাপের মুখে মহারাষ্ট্র সরকার—যার নেতৃত্বে বিজেপি—তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় এবং একটি কমিটি গঠন করে নীতিমালা পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেয়। তবে এই পদক্ষেপও বিরোধিতা থামাতে পারেনি।
এদিকে, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হিন্দি ভাষাভাষীদের ওপর হামলার খবর পাওয়া গেছে। এপ্রিল মাসে থানে জেলায় এক বাসিন্দাকে ‘এক্সকিউজ মি’ বলার কারণে মারধরের শিকার হতে হয়। মুম্বাইয়ে মারাঠি না জানার কারণে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর করে এমএনএস (মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা)-এর কর্মীরা। মে মাসে একটি দম্পতি ডেলিভারি এজেন্টকে অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ তিনি মারাঠিতে কথা বলেননি।
সম্প্রতি, মুম্বাইয়ের এক দোকানদারকে মারাঠি না বলায় মারধরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
এই ইস্যুতে প্রায় দুই দশক পর একসঙ্গে মঞ্চে এসেছেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতা—উদ্ধব ঠাকরে (শিবসেনা-ইউবিটি) ও রাজ ঠাকরে (এমএনএস)। তারা ভাষা আরোপের বিরুদ্ধে একত্রে সমাবেশ করে ‘মারাঠি গর্ব’ রক্ষার ডাক দিয়েছেন। রাজ্যের আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনের আগে এই রাজনৈতিক সমঝোতা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সাবেক রাজনৈতিক সাংবাদিক প্রশান্ত দীক্ষিত বলেন, ‘মারাঠি ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে মানুষের আবেগ অনেক গভীর। বিশেষ করে মুম্বাইতে এটি দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।’
১৯৬০-৭০-এর দশকে বল ঠাকরের নেতৃত্বে শিবসেনা দক্ষিণ ভারতীয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। পরবর্তীতে তারা উত্তর ভারতের বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে।
ভারতের সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে মুম্বাইয়ে হিন্দিভাষী জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই জাতীয়তাবাদী প্রচারণা আসন্ন নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে।
তবে অনেকে এর সমালোচনা করছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘ভাষাগত পরিচিতিকে কেন্দ্র করে রাজনীতি দুঃখজনক। এটি সহিংসতা উসকে দেয়, যা ভারতের সবচেয়ে শিল্পোন্নত রাজ্যে অনুচিত।’
প্রশান্ত দীক্ষিত বলেন, ‘মানুষ এখন বাস্তব উন্নয়ন চায়—চাকরি, নীতিমালা ও জীবনের মানোন্নয়ন। শুধু আবেগ দিয়ে ভোটার ধরে রাখা যাবে না।’
সূত্র: বিবিসি।
রাকিব