ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

উচ্চশিক্ষায় বিদেশমুখী তরুণেরা: কেন বাড়ছে এই তাড়া?

রাশেদুল ইসলাম সম্রাট

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১১:৫৯, ৬ জুলাই ২০২৫

উচ্চশিক্ষায় বিদেশমুখী তরুণেরা: কেন বাড়ছে এই তাড়া?

উচ্চশিক্ষায় বিদেশমুখী তরুণেরা

বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আগে যেখানে কেবল মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই স্কলারশিপের মাধ্যমে এই সুযোগ পেতেন, এখন এই প্রবণতাটি অনেক বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। ধনাঢ্য, উচ্চমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাও বিভিন্নভাবে অর্থের সংস্থান করে বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। কেউ নিজের বা পরিবারের সঞ্চয় ভেঙে, কেউবা ব্যাংক ঋণ নিয়ে হলেও লক্ষ্য একটাই দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ।

তথ্য বলছে, দেশে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর হার কমছে না। বরং বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ইউনেসকোর ২০২৩ সালের ‘Global Flow of Tertiary-Level Students’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী ৫৫টি দেশে পড়তে গেছেন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২ জন অর্থাৎ, এক দশকে দ্বিগুণের বেশি। একই প্রবণতা দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টস ডেটায়ও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল ১৫ কোটি ৪ লাখ ডলার; ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই অঙ্ক দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায়। প্রশ্ন হলো, কেন এই তাড়াহুড়ো?

বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এ ধারার পেছনে কিছু গভীর ও বাস্তব কারণ রয়েছে:

১. শিক্ষার মান নিয়ে অনিশ্চয়তা
দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখনও আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি। কোর্স কারিকুলামের আধুনিকায়ন, গবেষণার সুযোগ এবং শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ এই তিনটি ক্ষেত্রে এখনও ঘাটতি রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, এখানকার ডিগ্রি চাকরির বাজারে বাস্তব স্কিল নিশ্চিত করতে পারে না। ফলস্বরূপ, তারা মনে করেন যে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করলে তারা আধুনিক প্রযুক্তি, প্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রম এবং বাস্তবমুখী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারবেন।

২. চাকরির সুযোগ সীমিত এবং প্রতিযোগিতা তীব্র
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করেও চাকরি পাওয়া অনেক সময় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও চাকরির বাজারে অনৈতিকতা, ঘুষ এবং পরিচিতির প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পায়। অপরদিকে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সেই দেশের বাজারে শিক্ষার্থীরা সরাসরি কাজের সুযোগ পান, যা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য বড় একটি প্লাসপয়েন্ট। অনেকেই এটিকে ভবিষ্যতের ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবে দেখছেন।

৩. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেশনজট
বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষকদের ধর্মঘট বা প্রশাসনিক জটিলতায় শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ৪ বছরের অনার্স করতে অনেক সময় ৫–৬ বছর লেগে যায়। অন্যদিকে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়েই তাদের ডিগ্রি শেষ করতে পারেন। সময়ই তো জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ এই উপলব্ধিই অনেককে বিদেশমুখী করছে।

৪. মানবিক সুযোগ, জীবনযাত্রার মান এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা
বিদেশে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পার্টটাইম চাকরির সুযোগ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ জীবনযাত্রা এবং ভবিষ্যতে নাগরিকত্ব লাভের সম্ভাবনা এইসব বিষয় অনেক শিক্ষার্থীর জন্য নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। তারা শুধু শিক্ষাই নয়, একটি মানসম্মত জীবনের স্বপ্ন দেখেন। বিশেষ করে ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই আকর্ষণ অনেক বেশি কাজ করে।

৫. তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সহজলভ্যতা
আগে বিদেশে পড়ার প্রস্তুতি বলতে বোঝাতো বড়সড় আর্থিক ব্যয় ও তথ্যসংকট। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য এক ক্লিকেই পাওয়া যায় যেমন: কোন ইউনিভার্সিটি ভালো, কোথায় স্কলারশিপ পাওয়া যায়, কীভাবে আবেদন করতে হয়, ভিসা প্রসেস, পার্টটাইম কাজের সুযোগ ইত্যাদি। ইউটিউব, ব্লগ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা অভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের গল্প নতুনদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
২০২৩ সালের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র (৮,৫২৪ জন), যুক্তরাজ্য (৬,৫৮৬ জন), কানাডা (৫,৮৩৫ জন) এবং অস্ট্রেলিয়া। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে সবসময়ই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি সুযোগ থাকে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অষ্টম, যেখানে আগের বছর ছিল ১৩তম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে কিছু কড়াকড়ি লক্ষ্য করা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নজরদারি, ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টে দেরি ইত্যাদি যুক্ত হয়েছে। তবুও শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে নেই, তারা এখনো যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেছে।

তাহলে আমাদের করণীয় কী? উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চাওয়া একটি স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু যখন সেটি বাধ্যতামূলক এক ট্র্যাডিশনে রূপ নেয়, তখন তা জাতীয় স্বার্থের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। এই একমুখী প্রবণতা থেকে সরে আসতে হলে কোন উদ্যোগগুলো এখন সবচেয়ে জরুরি?

•    দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে
•    ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি সংযোগ তৈরি করে বাস্তবমুখী শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে
•    গবেষণায় বাজেট ও গাইডেন্স বাড়াতে হবে
•    তরুণ শিক্ষকদের যুক্ত করতে হবে এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সম্মানজনকভাবে কাজে লাগাতে হবে
•    ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি, ল্যাব, ক্যান্টিন ইত্যাদির আধুনিকায়ন করতে হবে
•    পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টার্নশিপ বা চাকরি সংযোগের উদ্যোগ নিতে হবে

তথ্যপ্রযুক্তি আর গ্লোবালাইজেশনের যুগে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই সুযোগ যেন আমাদের দেশের প্রতি আস্থা হারানোর কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এটা ঠিক, বিদেশে গেলে অনেকেই রেস্টুরেন্ট, ডেলিভারি, সুপারশপে খণ্ডকালীন কাজ করেন এবং সেটি গর্বের সাথেই বলেন। অথচ দেশে এসে একই কাজ করতে অনেকে লজ্জাবোধ করেন। এই দ্বিচারিতা আমাদের মানসিকতার একটি দুর্বল দিক। শুধু চাকরি পাওয়া, বেসরকারি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঢোকাই যেন শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য না হয়। শিক্ষার্থীদের মনে এই বিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে যে, উদ্যোক্তা হওয়াও একধরনের ‘ক্যারিয়ার সিকিউরিটি’। গবেষণা, উদ্ভাবন কিংবা একটি স্টার্টআপ শুরু করাও হতে পারে ব্যক্তিগত ও জাতীয় অগ্রগতির সেরা পথ। এবং এই সব কিছুই সম্ভব দেশে থেকেই, নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে। আমাদের স্বপ্ন হওয়া উচিত, এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে একজন শিক্ষার্থী গর্ব করে বলতে পারেন: "এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই আমি গড়েছি আমার ভবিষ্যৎ। বিদেশে নয় নিজের দেশেই আমি স্বপ্ন দেখেছি, আর সেই স্বপ্ন বাস্তব করেছি।" এই পরিবর্তন কেবল কাঠামোগত নয়, এটি একটি মানসিক বিপ্লব। শুধু বিদেশে যাওয়ার দৌড়ে নয়, এই সময়ই শিক্ষার্থীদের দেশের জন্য ভাবার, গড়ার, এবং নেতৃত্বের ভূমিকা নেওয়ার শ্রেষ্ঠ সুযোগ।

লেখক: রাশেদুল ইসলাম সম্রাট, শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

তাসমিম

×