
ছবি: সংগৃহীত।
লিভার ক্যান্সার নিয়ে নতুন এক বৈশ্বিক সতর্কতা এসেছে, যা যেমন আতঙ্কজনক, তেমনি কিছুটা আশাব্যঞ্জক তথ্যও দিয়েছে।
দ্য ল্যানসেট কমিশন অন লিভার ক্যান্সার–এর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে নতুন করে ৮ লাখ ৭০ হাজার লিভার ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৫ লাখ ২০ হাজারে, এবং এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে স্থূলতা (অতিরিক্ত ওজন)।
একইসঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে-২০২২ সালে যেখানে এই রোগে মৃত্যু ছিল ৭ লাখ ৬০ হাজার, ২০৫০ সালে তা বেড়ে ১৩ লাখ ৭০ হাজার-এ পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তথ্য লিভার ক্যান্সারকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল ক্যান্সারঘাতী রোগের কাতারে নিয়ে যাচ্ছে।
স্থূলতার কারণে বাড়ছে লিভার ক্যান্সার: কী বলছে গবেষণা?
ল্যানসেট কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, লিভার ফ্যাট জমে যাওয়া এবং মেটাবলিক জটিলতার ফলে তৈরি হওয়া রোগ MASLD (পূর্বে পরিচিত ছিল NAFLD নামে) এখন অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল কারণ হয়ে উঠেছে লিভার ক্যান্সারের। এর সবচেয়ে গুরুতর রূপ MASH (inflammatory stage)-এর সঙ্গে যুক্ত ক্যান্সারের হার ২০২২ সালের ৮ শতাংশ থেকে ২০৫০ সালে ১১ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
পূর্বের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শরীরের ওজন বৃদ্ধি (BMI বেশি হলে) লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি তিন গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। ২০২১ সালে উচ্চ BMI-জনিত প্রতিবন্ধকতা এবং মৃত্যু হার (DALYs) বিশ্বব্যাপী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখে, যা ১৯৯০ সালের তুলনায় ৩২৩% বেশি।
উদ্বেগজনক পূর্বাভাস:
ল্যানসেটের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ লিভার ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫.২ মিলিয়নে এবং মৃত্যুহার ৭৬০,০০০ থেকে বেড়ে ১৩.৭ মিলিয়নে পৌঁছাবে। একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে Nature জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি মডেলিং গবেষণাও, যেখানে ২০৪০ সালের মধ্যে ক্যান্সার বৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে ৫৪%।
এই বৃদ্ধির মূল কারণগুলো-স্থূলতা, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ, এবং ভাইরাল হেপাটাইটিস। যদিও হেপাটাইটিস-জনিত ক্যান্সারের হার সামান্য কমতে পারে, তবে স্থূলতাজনিত লিভার ক্যান্সার উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ায় দ্রুত বাড়ছে।
লিভার ক্যান্সার কী?
লিভার ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যেখানে যকৃতে ক্যান্সার কোষ গঠন হতে থাকে। এটি হয় প্রাথমিক, অর্থাৎ লিভারেই উৎপত্তি ঘটে; অথবা দ্বিতীয়িক, যেখানে অন্য অঙ্গ থেকে ছড়িয়ে পড়ে লিভারে।
প্রধান প্রকারভেদগুলো:
হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা (HCC): প্রাপ্তবয়স্কদের সবচেয়ে সাধারণ প্রকার
ইন্ট্রাহেপাটিক কোলাঞ্জিওকার্সিনোমা: লিভারের ভেতরের পিত্তনালীতে উৎপত্তি
অ্যাঞ্জিওসারকোমা / হেম্যাঞ্জিওসারকোমা: লিভারের রক্তনালিতে গঠিত দুর্লভ, দ্রুত ছড়ানো ক্যান্সার
হেপাটোব্লাস্টোমা: শিশুদের মধ্যে বিরল ও প্রধানত দেখা যায়
ঝুঁকি কী কী?
হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণ
অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান
স্থূলতা ও ডায়াবেটিস
সিরোসিস ও বংশগত লিভার রোগ
অ্যাফ্লাটক্সিন নামক রাসায়নিকের সংস্পর্শ
কেন এত মারাত্মক লিভার ক্যান্সার?
এই রোগ অনেক সময় শেষ ধাপে গিয়ে ধরা পড়ে, যখন চিকিৎসা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া লিভার মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হওয়ায় এর চিকিৎসাও জটিল। MASLD থেকে MASH, এরপর সিরোসিস ও অবশেষে ক্যান্সারে রূপান্তর দ্রুত ঘটে।
বর্তমানে ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার মাত্র ৫% থেকে ৩০% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা একে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্যান্সারগুলোর একটি করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়ান ঝু বলেন, “লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় অন্যতম জটিল, এবং এর চিকিৎসার সাফল্য হারও সীমিত। এখনই যদি বৈশ্বিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে আমরা এই রোগের প্রায় দ্বিগুণ বিস্তার দেখতে পারি।”
চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর অধ্যাপক স্টিফেন চ্যান জানান, “তিন ভাগের দুই ভাগ লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য, মূলত হেপাটাইটিস, অ্যালকোহল ও স্থূলতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। এটি আমাদের জন্য বড় সুযোগ—জীবন রক্ষা ও স্বাস্থ্য খরচ কমানোর।”
প্রতিরোধের উপায়: ছোট পদক্ষেপ, বড় পার্থক্য
ল্যানসেটের মতে, ৬০% লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। প্রয়োজন সচেতনতা ও জীবনধারায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন:
সুস্থ ওজন ও সক্রিয় জীবনযাপন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা শরীরচর্চা, এবং ফল, সবজি, পূর্ণশস্য ও স্বাস্থ্যকর প্রোটিনে ভরপুর খাদ্যাভ্যাস লিভারের জন্য উপকারী।
নিয়মিত স্ক্রিনিং: স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা লিভার এনজাইম বেশি এমন ব্যক্তিদের নিয়মিত লিভার পরীক্ষা করা উচিত।
হেপাটাইটিস বি টিকা ও সি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ: নবজাতকদের টিকাদান ও প্রাপ্তবয়স্কদের অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা ভাইরাসজনিত ক্যান্সার রোধে কার্যকর।
অ্যালকোহল ও চিনি কমানো: অ্যালকোহল বিশ্বে ১৯% লিভার ক্যান্সার মৃত্যুর জন্য দায়ী, আর চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার স্থূলতা ও ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ওজন কমাতে চিকিৎসা সহায়তা: উচ্চ BMI বা মেটাবলিক সিনড্রোম থাকলে পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের সহায়তায় ওজন হ্রাসে খাদ্য পরিবর্তন থেকে শুরু করে প্রয়োজন হলে ব্যারিয়াট্রিক সার্জারির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এমন সার্জারিতে ৯২% পর্যন্ত ফ্যাটি লিভার নিরাময় সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য নীতিতে স্থূলতা, অ্যালকোহল সেবন ও ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে লাখো মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।
মিরাজ খান