
ইংল্যান্ডে থাকলেও হামজা চৌধুরীর মনটা বাংলাদেশেই পড়ে থাকে
১৮ মার্চ ২০২৫। কোনো শিরোপা বা ম্যাচ না জিতেও বাংলাদেশের ফুটবলে ঐতিহাসিক এক দিন! ঢাকায় পা-রেখে সরাসরি বাপ-দাদার জন্মভিটা হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার ¯œানঘাটে উড়ে যান হামজা চৌধুরী। বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্যায়ের লিগ ইপিএলে খেলা তারকা ফুটবলারকে বরণ করে নিতে সেদিন অভাবনীয় এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে এসে তিনি যেমন দেখেছেন উত্তাল জনস্রোত, তেমনি অনুভব করেছেন মানুষের উষ্ণ ভালোবাসা, যা তার মনে গেঁথে থাকবে আজীবন।
তাঁর ক্লাব লেস্টার সিটিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই মিডফিল্ডার জানিয়েছেন, হৃদয়ের অনেকটা অংশ বাংলাদেশেই, ‘যখন প্রথম আমি বাংলাদেশে যাই, তখন গ্রামে ফিরেছিলাম। একেবারে গ্রামীণ জায়গা, যেখানে আমার শৈশব কেটেছে। ছোটবেলায় যেভাবে রাস্তায় খেলেছি, সেই অভিজ্ঞতা এবার আমার সন্তানদেরও দিতে পেরেছি, এটা আমার জীবনের সেরা তৃপ্তির একটা।’
বাবা-মা-স্ত্রী এবং তিন সন্তান সঙ্গে নিয়ে হামজা সেদিন যখন দেশের মাটিতে পা রাখেন, তার সন্তানরাও যেন হঠাৎই চলে যান তাদের বাবার শৈশবে। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে ফুটবল নিয়ে পাগল, সারাক্ষণ খেলা দেখে। মেয়ে আবার শিল্পমনা, তবে তার জন্যও এই ভ্রমণটা ছিল খুব স্পেশাল।’ বাংলাদেশের মানুষ তাকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছে, সেটি কোনোভাবেই কেবল খেলার কারণে নয় বলে মনে করেন তিনি। বরং এটার পেছনে রয়েছে জাতিগত গর্ব, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা আর একাত্মতা, ‘ওরা আমাকে শুধু একজন ফুটবলার নয়, একজন আপনজন হিসেবে দেখেছে।
কেউ কেউ বলবে এতটা ভালোবাসা ভয়ংকর হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এটা হৃদয়ের কথা। এরা সবাই আমাকে ভালোবাসতে এসেছে, ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানিয়েছে, এর চেয়ে ভালো অনুভূতি আর কী হতে পারে?’ ১০ জুন’২০২৫, স্থান ঢাকা স্টেডিয়াম, প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুর। হাজারো মানুষ যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানায়, স্টেডিয়াম যখন ম্যাচ শুরুর চার ঘণ্টা আগেই পূর্ণ হয়ে যায়, তখন হামজা বুঝে যান, এ দেশ তার নিজের, ‘আমরা ইংল্যান্ডে খেলি ঠিকই, কিন্তু এমন ভালোবাসা খুব কমই মেলে। এখানকার মানুষের উন্মাদনা, আবেগ, ভালোবাসা, সব মিলিয়ে এটা একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি, যা ভাষায় বোঝানো যায় না।’
এই অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে যখন তিনি বাংলাদেশের হয়ে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করেন। সেটিও আবার হেড দিয়ে, ‘সত্যি বলছি, আমি নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! হেড দিয়ে গোল করব, সেটা ভাবিনি কখনো।’ সেদিনই বলেছিলেন হামজা। ক্রিকেটের সাফল্যের ভিড়ে যেটুকু চাপা পড়ে ছিল, তা আবার জেগে উঠেছে হামজাদের মতো তরুণদের হাত ধরে, ‘দলীয় বন্ধন না থাকলে সাফল্য আসে না। মাঠে কৌশল যেমন দরকার, মাঠের বাইরে সম্পর্কটাও ততটাই জরুরি।’
শেষ পর্যন্ত, হামজার গল্প শুধু একজন ইউরোপীয় ফুটবলারের নয়, যে হঠাৎ জাতীয় দলে খেলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। এটা একজন মানুষের গল্প, যিনি শিকড়ের ডাক শুনেছেন, হৃদয়ের টানে ফিরেছেন তার নিজের দেশে। বাংলাদেশের মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজের আসল ঠিকানা, যেখানে ভালোবাসা বিনিময়ে কোনো ভাষার দরকার হয় না, এটা যেন শুধুই আত্মিক অনুভব।
প্যানেল হু