ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জাতীয় খেলা কাবাডি

শাহ জালাল, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ১০:০১, ৩০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১০:০৫, ৩০ জুলাই ২০২৫

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জাতীয় খেলা কাবাডি

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

কাবাডি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। মূলত হা-ডু-ডু নামটির পোশাকী নাম কাবাডি। ১৯৭২ সালে কাবাডিকে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও পরের বছর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অপেশাদার কাবাডি ফেডারেশন গঠিত হয়। উনিশ শতকের এই সময় থেকেই কাবাডি ছিল গ্রামবাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। 

যদিও বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় কাবাডির অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করেছিল। কিন্তু বর্তমানে এখন তার তেমন একটা বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। যদিও একটা সময়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে কাবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেগুলো তার নিজস্ব ধারাবাহিকতা হারিয়েছে। বলা চলে, খেলাধুলা শিশু-কিশোরের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 

কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। ফলে বর্তমানের অধিকাংশ শিশু-কিশোর খেলাধুলাতে আর মেতে উঠার সুযোগ পাচ্ছে না। যদিও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে গ্রামীণ নানা খেলা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। শহরের পাশাপাশি গ্রামেও এখন বিজ্ঞানের যথেষ্ট ছোঁয়া লেগেছে। প্রযুক্তিগত এ ছোঁয়া যেন কেড়ে নিচ্ছে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যকে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের লালিত গ্রামীণ সংস্কৃতি আর বিলুপ্তির পথে যেন চিত্তবিনোদনের প্রধান উৎস খেলাধুলাও। আর এরই ধারাবাহিকতায় বিলুপ্তির পথের সারথি হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। একটা সময় ছিল, খেলাধুলা নিয়ে গ্রামবাংলায় মেতে উঠত এক আনন্দময়ী আমেশ। কিন্তু সে দৃশ্য যেন আজ কেবল স্মৃতি। অথচ সে সময়ে গ্রাম-বাংলায় এই হাডুডু খেলার ধুম ছিল বেশ। উৎসব করে আয়োজন করা হতো খেলাটির। এলাকার চারদিকে ছিল উৎসব আর আনন্দের জোয়ার। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই হাডুডু। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে হাডুডু পাঠ্যপুস্তকের কেবল একটি নাম। 

এ যুগের ছেলেমেয়েরা তাদের দেশীয় সংস্কৃতি চেয়ে বিদেশি বিষয় নিয়েই মাতামাতি করে বেশি। এর ভুক্তভোগী হয়েছে এই খেলাও। কালক্রমে এ খেলার কদর হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামীণ জনপদের মানুষের কাছে একটা সময় জনপ্রিয় খেলা হিসেবে পরিচিত থাকলেও এ সময়ে এসে ছেলেমেয়েরা সে খেলাগুলোর লোকেমুখে শুনে থাকলেও বাস্তবে কখনো দেখেইনি। বলতে গেলে এ খেলাধুলার আয়োজন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ফলে আজকালকার এই প্রযুক্তিগত যুগে আমাদের ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত সময় পার করছে বিভিন্ন সামাজিক সাইটে। আর আসক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন ভিত্তিক নানা ধরনের গেমসে। বস্তুতপক্ষে জাতীয় খেলা নিয়ে দেশের জাতীয় পর্যায়ে নেই কোনো যথাযথ উদ্যোগ। 

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও বিদেশি খেলার কাছে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ খেলা। আমাদের উচিত বর্তমান প্রজন্মকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করার পাশাপাশি হাডুডু খেলার প্রতি মনোনিবেশ করা। নিয়মিত আয়োজন করা দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ফলে কাবাডির মতো অন্যান্য খেলাও আর হারানোর তালিকায় যুক্ত হবে না। তাই এর জন্য চাই যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা।

গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক সময়ের জনপ্রিয় খেলা হা-ডু-ডু এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। বর্ষা এলেই গ্রামের কাচা রাস্তায়, মাঠ, বাগানে বা খোলা মাঠে জমজমাট ও উৎসবমুখর পরিবেশে হতো এ হা-ডু-ডু খেলা।

কিন্তু কালের আবর্তে সেই খেলা এখন আর দেখা যায় না। আধুনিক খেলা এবং যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততার কাছে হেরে গেছে এ গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় এ খেলাটি।

এখন আর কোনো উৎসবে বা বিশেষ দিবসে এ খেলার আয়োজন হয় না। তাই নতুন প্রজন্ম জানে না এ খেলা সম্পর্কে। ভুলতে বসছেন অন্যরাও। তাই নতুন করে খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিশেষ দিন বা উৎসবে গ্রামে গ্রামে জমজমাট ভাবেই হা-ডু-ডু খেলার আয়োজন করা হতো। চারদিকে বিরাজ করতো আনন্দ-উচ্ছ্বাস। হা-ডু-ডু খেলার আয়োজনকে ঘিরে গ্রামজুড়ে চলতো মাইকিং প্রচার-প্রচারণা। দূর-দুরান্ত, পাড়া-মহল্লা থেকে শত শত মানুষ গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় হা-ডু-ডু খেলা দেখতে আসতেন। জমজমাট ছিল এ আয়োজন। রঙিন কাগজ ও পতাকায় সাজানো হতো খেলার মাঠ ও আশ-পাশের এলাকা। খেলা শেষে বিজয়ী দলকে দেওয়া হতো রঙিন বা সাদা কালো টেলিভিশন, রেডিও, চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, স্বর্ণ বা রূপার মেডেলসহ বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় পুরস্কার। খেলা শেষ হয়ে গেলেও মাসব্যাপী সেই খেলা নিয়ে চলতো আলোচনা। আগ্রহ থাকায় প্রতিবছরই বর্ষার মৌসুম এলেই গ্রামে গ্রামে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি হতো। কিশোর-যুবক এমনকি বৃদ্ধরাও হা-ডু-ডু খেলার আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কিন্তু এখন আর গ্রামে সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না।

ক্রিকেট-ফুটবলসহ আধুনিক বিভিন্ন খেলা, মোবাইল গেইম, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইটে আসক্ত হয়ে পড়েছে যুব সমাজ তাই হা-ডু-ডু খেলা অনেকেই ভুলে গেছেন। তবে এখনও মাঝে মধ্যে গ্রামে গ্রামের দুই/এক জায়গায় খেলাটির আয়োজন হতে দেখা যায়।

এমনি প্রীতি খেলার আয়োজন দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে বারদী ইউনিয়নের নুনেরটেক গ্রামে । প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমএলেই হা ডু-ডু বা কাবাডি খেলা শুরু হয়। এলাকার ছেলেরা সবাই মিলে দুইটি গ্রুপ বিভক্ত হয়ে এ খেলায় মেতে ওঠেন। সেখানে দেখা গেছে কয়েক শতাধিক দর্শকদের উচ্ছ্বাস। 

বিলুপ্তপ্রায় সেই হা-ডু-ডু খেলাটি দেখতে ভিড় জমিয়েছেন অনেকে। তাদের মধ্যে  সোলাইমান  বলেন, হা-ডু-ডু খেলাটি গ্রামের অনেক জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু এখন আর তেমন দেখা যায় না। গ্রামে এ খেলার আয়োজন হতে দেখা যায়। হঠাৎ করেই মাঠের ওপর হা-ডু-ডু খেলা দেখতে পেয়ে ছুটে এলাম। বহু বছর পর খেলা দেখে খুব ভালোই লাগছে। 

আরেক দর্শক এলাকার প্রবীণ মুরব্বী আবদুল কাদির মেম্বার বলেন, বিকেলে বাসা থেকে ঘুরতে বের হয়েছি, বাজারের মাঠে হা-ডু-ডু খেলা চলছিল। দেখেই ছুটে এলাম। মনে হচ্ছিল সেই পুরনো দিনে ফিরে এসেছে। শত শত নারী-পুরুষ এ খেলা উপভোগ করেন। নানা কারণে এ খেলাটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটিকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

স্থানীয় হজরত আলী সহ কয়েকজন মুরব্বী জানালেন, গ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে হা-ডু-ডু খেলাটি। জনপ্রিয় খেলাটি আবার ফিরিয়ে আনার দরকার। তাহলে গ্রাম বাংলার এ খেলাটি প্রাণ ফিরে পাবে।

এ ব্যাপারে কাবাডি খেলা প্রেমী শুক্কুর আলী বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যের হা-ডু-ডু খেলাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্রামে এখনও প্রতিভাবান খেলোয়াড় রয়েছেন। এ খেলাটি ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। তবে আমরা প্রতিবছরই কাবাডির আয়োজন করছি। আমাদের এলাকায়  এখন পর্যন্ত বেশ কয়েক জন ভালো কাবাডি খেলোয়াড় রয়েছেন। গ্রামের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিলে ভালো ভালো খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।

নোভা

×