
এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের ম্যাচ ও আসন্ন মৌসুমের জন্য ঢাকা আবাহনীকে প্রস্তুত করছেন কোচ মারুফুল হক।
বাংলাদেশের কোচিং অঙ্গনের অন্যতম পথপ্রদর্শক মারুফুল হক। জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করেছেন, ঘরোয়া লিগে বহু শিরোপা জিতেছেন, আর দেশের কোচিং শিক্ষায় এনেছেন বৈপ্লবিক চেতনা। ফুটবলকে নিঃশ্বাসের মতো ধারণ করেন তিনি। জীবনের নানা বাঁক, সংকট, সফলতা আর ভবিষ্যতের রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে পরিবার থেকে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। তার প্লেয়িং ক্যারিয়ারটা খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি জানান, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে যে বছর আমি বাইন্ডিং ফ্রি হই, সে বছরই বুয়েটে চাকরি পেয়ে যাই। পরিবার বলল-চাকরি করো, খেলার প্রয়োজন নেই। আবার বুয়েট বললÑ লিগ খেলা যাবে না, কোচিং করা যাবে। এরপর দেশের প্রথিতযশা অধ্যাপক ড. শামীমুজ্জামান বসুনিয়া স্যারের সহায়তায় ফুচুরো ফিফা কোচেস কোর্সে অংশ নেওয়া হয় তার।
এক সময় কোর্স ইন্সট্রাক্টর মি. ওয়াল্টার ফিজি মারুফুল হককে বলেন, ‘তুমি লেগে থাকো, ভালো কোচ হতে পারবে।’ ১৯৯৫-১৯৯৭ পর্যন্ত সময়টায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য ও জাতীয় কোচ শ্রী প্রতাপ শংকর হাজরাস্যার আমার বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন। বাবা প্রয়াত অধ্যক্ষ নূরুল হক, মা মিসেস রওশন আরা হক, ভাইবোন ও স্ত্রীÑ সবাই আমাকে উৎসাহিত করতেন। এই পারিবারিক ও পেশাগত অনুপ্রেরণাই তাকে কোচিংয়ে ঠেলে দেয়।
১৯৯৫ সালে এএফসি ‘সি’ লাইসেন্স করার পর বাংলাদেশ আর্মি টিমের বিভিন্ন ইউনিটে এবং ময়মনসিংহ মোহামেডান টিমে কোচিং করিয়ে ছোটখাটো সাফল্য আসে। ২০০১ সালে ‘বি’ লাইসেন্স করার পর জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার শ্রদ্ধেয় সাঈদ হাসান কানন বাড্ডা জাগরণীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সে বছর বাড্ডা জাগরণী প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার লিগে উন্নীত হয়। ২০০২ সালেও প্রিমিয়ার লিগে বাড্ডা জাগরণীর সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করা হয়।
মাঝে কিছুদিন বিরতির পর আবারও ২০০৭ সালে প্রথম বিভাগে বাড্ডা জাগরণীর হেড কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রখ্যাত কোচ প্রতাপ শঙ্কর হাজরা স্যার, ঢাকা মোহামেডান এসসির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া মাসিক ৩০ হাজার টাকা সম্মানীতে ঢাকা মোহামেডান এসসি টিমের হেড কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি তথন বিনা- বাক্যব্যয়ে প্রস্তাবে রাজি হয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা হয়।
তখন ঢাকা মোহামেডান এএফসির হেড কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে চারদিকে নানা মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কিছু পত্রিকায় এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিলÑ ‘কোথাকার কোন মারুফুল মোহামেডানের হেড কোচের দায়িত্বে!’ এমনকি তৎকালীন অনেক ফুটবল বিশারদ বলেছিলেন, ‘যার ফুটবল খেলার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, শুধুমাত্র বই পড়ে বা ল্যাপটপ দিয়ে কোচিং হয় না।’ তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে, কোচিং- জ্ঞানকে পুঁজি করে নীরবে কাজ করা হয়।
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেশের টপ লেভেলে কোচিং শুরু করার সেই বছরেই জুয়েল রানা, আমিনুল, রজনী ও হাসান আল মামুনের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, যারা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন। সহকারী হিসেবে ছিলেন ফুটবল-জ্ঞানসম্পন্ন সাইফুল বারী টিটু। তার শৈশব ও কৈশর কেটেছে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল মাঠে, যেখানে সকল ধরনের খেলাধুলার চর্চা ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিকস, সাঁতারসহ অন্যান্য খেলায় সমান পারদর্শী তিনি। তবে তুলনামূলকভাবে ক্রিকেটেই বেশি ভালো খেলতেন। তবুও আবেগ ও ভালোবাসা ছিল ফুটবল।
একজন খেলোয়াড় ও কোচ এই দুটি একেবারেই ভিন্ন সত্তা। একজন খেলোয়াড় নিজের পারফরম্যান্সে মনোনিবেশ করে। কিন্তু একজন কোচকে দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের মাঠের ভেতর ও বাইরে যা কিছু ঘটে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। পারফরম্যান্সকে প্রভাবিত করে এমন প্রতিটি বিষয়ে চিন্তা করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তা বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হয়। মারুফুল হক জানান, আমি কোচ হওয়ার পর দেখলাম, দেশের কোচদের অনেক কিছুই ছিল নাÑতত্ত্বগত জ্ঞান, বৈজ্ঞানিক অনুশীলন, উন্নত পরিকল্পনা।
তখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করি। কোচিং-এ শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ শুরু করি, আর প্রচুর রিসার্চ করতে থাকি। ১৯৯৩ সালে আমি ঢাকা সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বিপিএড ডিগ্রি সম্পন্ন করি। সেই সময় এই কোর্সটি ছিল ১০ মাসের, যেখানে টিচিং মেথড, ফিজিওলজি, এনাটমি ও সাইকোলজি এই বিষয়গুলো নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাই। যদিও খুব গভীরভাবে নয়, তবুও এগুলোর প্রতি আগ্রহ জন্মে।
যদিও আমি আগেই এএফসি ‘এ’ লাইসেন্স পেয়েছিলাম, তবুও কেন জানি মনে হতো, কোচিং সম্পর্কে আমি এখনো অনেক কিছু জানি না। এই অনুভব থেকেই ২০১৫ সালে আমি ইংল্যান্ড থেকে (ইউইএফএ) লাইসেন্স অর্জন করি। এএফসি ‘এ’ লাইসেন্স কোর্স সাধারণত ২ থেকে ১২ মাসের মধ্যে হয়, তবে আমাদের সময়ে মাত্র ১ মাসে তা শেষ হয়েছিল। এতে কিছুটা শেখার গ্যাপ থেকে যায়।
উইয়েফা ‘এ’ লাইসেন্সের ব্যপ্তি ছিল দুই বছর। এখানে বিশেষ করে পেশাদার দলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত ও দলগত পারফরম্যান্সে পরিবর্তন আনার জন্য টেকনিক, ট্যাকটিকস, ফিজিক্যাল, মানসিক ও সামাজিক দিকগুলোÑ সবকিছুই মাঠের ভেতর ও বাইরের আচরণসহ বিশ্লেষণধর্মী পদ্ধতিতে হাতে-কলমে শেখানো হয়। আমি এই কোর্স থেকে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পেয়েছি, তা ২০১৫ সাল থেকে আমার দলের মেধা ও সক্ষমতা অনুযায়ী প্রয়োগ করার চেষ্টা করি এবং বেশির ভাগ সময়েই সফল হই।
দেশ সেরা কোচ মারুফুল হক জানান, সাধারণত আমি বেশি পছন্দ করি পাসিং ও প্রেসিং ফুটবল। অর্থাৎ বল যদি আমার দলে থাকে, তাহলে গোলকিপার থেকে বিল্ডআপ করে তিনটি জোনে পজিশনিং করে আমরা প্রতিপক্ষের গোলসীমায় পৌঁছাই। পক্ষান্তরে, যদি বল প্রতিপক্ষের কাছে থাকে, তাহলে তাদের পিছন থেকে বিল্ডআপ ভেঙে দিতে হাই প্রেসিং করি অথবা আমরা বল হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই কাউন্টার প্রেসিং করি যেন দ্রুত বলের দখল ফিরে পাওয়া যায়। তবে আমি কীভাবে আমার দলকে খেলাব, তা নির্ভর করে আমার খেলোয়াড়দের মেধা, যোগ্যতা এবং প্রতিপক্ষ দলের শক্তি ও দুর্বলতার ওপর।
তিনি জানান, শারীরিকভাবে ফিট, মানসিকভাবে ইতিবাচক খেলোয়াড় তৈরি করা আমার দর্শনের মূল। ট্রেনিংয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করি যেখানে আত্মবিশ্বাস, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ, সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সহযোগিতার চর্চা হয়। আমি বিশ্বাস করিÑ প্রতিটি খেলোয়াড় আলাদা, তাই কোচিংও কাস্টমাইজড হওয়া উচিত। তিনি বলেন, জাতীয় দলে আমাদের গঠনগত দুর্বলতা আছে। বয়সভিত্তিক দলগুলো সঠিকভাবে গড়ে উঠছে না, লিগ কাঠামো দুর্বল এবং নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলি না বললেই চলে, খেললেও সমশক্তি বা দুর্বল দলের সঙ্গেই বেশি খেলে থাকি। সমস্যা গভীরে।
কাঠামোগত দুর্বলতা, নিয়মিত প্রতিযোগিতার অভাব, তরুণ খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক এক্সপোজার না থাকা। সব কিছু মিলিয়ে সমস্যা বহুমাত্রিক। শুধু কোচ পরিবর্তনে কিছু হবে না। একই সঙ্গে কোচের নিজের পছন্দমাফিক ফরমেশনে না গিয়ে খেলোয়াড়রা অভ্যস্ত বা তাদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী ফরমেশনে খেলানো উচিত।
মারুফুল বলেন, ২০০৮ থেকে বিভিন্ন ক্লাবে ও দলে কাজ করে ১১টি শিরোপা জিতেছি ২টি লিগ, ৪টি ফেডারেশন কাপ, ২টি স্বাধীনতা কাপ, ১টি সুপার কাপ, ১টি আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ। জাতীয় অনূর্ধ্ব ২০ দলকে সাফ চ্যাম্পিয়ন। এর বাইরে ৫টি লিগ, ১টি সুপার কাপ, ১টি ফেডারেশন কাপ, ১টি আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ এ রানার্সআপ। তবে আরামবাগকে স্বাধীনতা কাপ জেতানো ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সেই দলে ছিল তরুণ ও কম অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা।
অনেক সময় দেখা গেছে ভালো কাজ করেও তিনি অবমূল্যায়িত হয়েছেন। দল ভালো করেও কাক্সিক্ষত সম্মান পায়নি। দেশের কোচদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সমস্যা রয়েছে। আমি চাই জাতীয় দল নিয়মিত সাফের ফাইনাল খেলুক, বিশ্বকাপ বাছাইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক, ঘরোয়া ফুটবলে দর্শক ফিরুক এবং ক্লাব-ফেডারেশন যেন সঠিক পথে চলে।
২০১৭ সালে আরামবাগে আমি বাংলাদেশে প্রথম জিপিএস সিস্টেম চালু করি। সেখানে খেলোয়ড়দের প্রতিদিন ট্রেনিং ডাটা ও ম্যাচ ডাটা খেলোয়াড়দের সঙ্গে শেয়ার করতাম এবং তাদের কি করণীয় তা বলে দিতাম, তারা উৎসাহিত হয়ে তাদের সেরাটা ট্রেনিং ও ম্যাচে দিতে চেষ্টা করত, যার ফলে উন্নতিটা চোখে পড়ার মতো ছিল। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি একাডেমিতে কাজের অফার ছিল, বেতন কাঠামোর জন্য যাওয়া হয়নি। ২০১৫ সালে সার্ক অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী দলের হেড কোচের অফার ছিল। কিন্তু তৎকালীন সময়ে স্থানীয় ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকায় যাওয়া হয়নি।
প্যানেল হু