ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলেই 

আইসিডিডিআরবির তৈরি ডেঙ্গুর টিকা দেশে দেয়া হবে 

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ৩০ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১৭:৪১, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

আইসিডিডিআরবির তৈরি ডেঙ্গুর টিকা দেশে দেয়া হবে 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু জাফর

ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাংলাদেশ উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র’বাংলাদেশ আইসিডিডিআরবি ০০৫ নামের একটি টিকা তৈরি করেছে। যার ৩য় ধাপের টায়াল শেষ হয়েছে। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলেই দেশে এর ব্যবহার হতে পারে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বুধবার অধিদপ্তরের মিলনায়তনে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে দেশজুড়ে চলমান হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকাদান কর্মসূচির বিস্তারিত নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য জানিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু জাফর। এসময় তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে কয়টি টিকা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়েছে বেশিরভাগই এখনো ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি টিকা ‘কিউডেঙ্গা’র অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বর্তামনে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও আর্জেন্টিনাসহ কয়েকটি দেশে এই টিকার ব্যবহার হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এর ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। আমাদের আইসিডিডিআর’বির টিকা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায় এবং দেশীয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন পায় তাহলে আমরা তা দেশে দেবে। 

এসময় এই এইচপিভি টিকা নিয়ে কিছু মানুষ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এইচপিভি টিকার সাথে বন্ধ্যাত্বের কোন সম্পর্ক নেই। এই টিকা কার্যক্রমের সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের কোন নেতিবাচক সম্পর্ক নেই। এ ধরনের গুজব এবং প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার একটা কেন্দ্রে টিকা প্রদান কার্যক্রম চলাকালে হঠাৎ টিকা নেয়ার পর দুজন ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের অসুস্থ হওয়া দেখে পরবর্তীতে আরও কয়েকজন ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদেরকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ ভর্তি করা হয়। বর্তমানে এদের সবাই সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে পাঁচজন ছাত্রী হাসপাতালে ভর্তি হলেও কোন টিকা নেননি। আমরা প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘ম্যাস সাইকোজেনিক ইলনেস’ বলে ধারণা করছি। তবে এটির সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি একটি। 
তিনি আরো বলেন, সাধারণত যে কোন টিকা দেয়ার পর খুবই নগণ্য পরিমাণ টিকাগ্রহনকারীর শরীরে সাময়িক  নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তখন টিকা গ্রহণকারী শুয়ে বিশ্রাম নিলে খুবই অল্পসময়ের ভেতর ভালো বোধ করে। এটি মারাত্মক কোনো সমস্যা না। 

তিনি জানান, এই বছর এইচপিভি টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ১২,৫৩২। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৮ লাখ ১৭ হাজার ৩২৬ জনকে টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। ৭টি বিভাগে মাত্র ২৭১ জনের শরীরে জ্বর, ব্যথা এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। যেটা সংখ্যার বিচারে খুবই নগণ্য উল্লেখ করে মো. আবু জাফর বলেন, শতকার হিসেবে তা মাত্র ০.০০০১৪ শতাংশ।

বাংলাদেশে এই টিকাদান কর্মসূচীতে এইচপিভি টিকা বেলজিয়ামে উৎপাদিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে ১৪০টি দেশে এই টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে যার মধ্যে ১৪টি মুসলিম দেশ (সৌদি আরব, কাতার, ইউএই, মালয়েশিয়া, মরোক্ক, কুয়েত, মালদ্বীপ উল্লেখযোগ্য) অন্তর্ভুক্ত।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ডা. মো শিব্বির আহমেদ ওসমানী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মো: রিজওয়ানুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন ডা. এ বি এম আবু হানিফসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে ঢাকা বিভাগের প্রায় ১৫ লাখ কিশোরীকে এই টিকার ১ ডোজ দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার দেশের অন্য ৭ বিভাগে শুরু হয় এ কর্মসূচি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)’র ডেপুটি ডিরেক্টর শাহরিয়ার সাজ্জাদ জানান, প্রায় ৬২ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন কিশোরীকে এ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে মোট ১৮ দিনের ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে। এর মধ্যে প্রথম ১০ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও ইপিআই কেন্দ্রগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম চলবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্রীরা টিকা পাবে। কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টিকা নিতে অসমর্থ হলে তারা স্থায়ী কেন্দ্রে টিকা নিতে পারবেন। এছাড়া স্থায়ী কেন্দ্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীরাও টিকা গ্রহণ করতে পারবেন। পরবর্তী ৮ দিন নিয়মিত ইপিআই স্থায়ী ও অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রের মাধ্যমে কমিউনিটির ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত কিশোরীদের টিকা দেয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাদ পড়া পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্রীরাও টিকা নিতে পারবেন। এর জন্য িি.িাধীবঢ়র.মড়া.নফ সাইটে ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধনের তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। 
ইপিআইয়ের তথ্যমতে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের ১ ডোজ এইচপিভি টিকা গ্রহণের মাধ্যমেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এই ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি নারী প্রাণ হারান। দেশে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন আক্রান্ত হন এই ক্যান্সারে। মৃত্যু হয় প্রায় ৫ হাজার জনের। 
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ:
প্রাণঘাতী এই ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ অতিরিক্ত সাদা ¯্রাব হওয়া। অতিরিক্ত অথবা অনিয়মিত রক্ত¯্রাব, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় রক্তপাত, দুর্গন্ধযুক্ত ¯্রাব, শারীরিক মিলনের পর রক্তপাত, কোমর/তলপেট/উরুতে ব্যাথা।
কারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ:
যেসব নারী বাল্যবিবাহ হয়েছে তারা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। এছাড়া ঘন ঘন সন্তান প্রসব, অনিরাপদ শারীরিক মিল, একাধিক যৌনসঙ্গী, ধূমপায়ী, স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন জনগোষ্ঠী যেমন এইডস রোগী, এবং যেসব নারী প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন না। এবং সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের অথবা স্বাস্থ্য কর্মীর পরামর্শ নেন না তাদের এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। 
প্রতিরোধের উপায়:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের ১ ডোজ এইচপিভি টিকা প্রদানের মাধ্যমে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়া ৩০ ব্যছরের বেশি বয়স হলেই নিয়মিত জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিরুপণ পরীক্ষা করা ও সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করা হলে এটি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ এই রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
টিকা পরবর্তী বিরূপ প্রতিক্রিয়া:
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য এইচপিভি টিকা বিশ্বব্যাপী পরীক্ষিত, নিরাপদ ও কার্যকর। তারপরও কিছু ক্ষেত্রে টিকা পরবর্তী মৃদু বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেমন টিকার স্থানে লালচে ভাব, ব্যথা বা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। যা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এ ধরণের কোনো সমস্যা হলে এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বা কিশোরীকে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অতিসত্ত্বর নিয়ে যাবে।

স্বপ্না / রিয়াদ

×