ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পাইকগাছায় ডিঙি নৌকায় কপোতাক্ষে ভাসমান সুখেন-অন্নার জীবনসংগ্রাম

আশরাফুল ইসলাম সবুজ,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাইকগাছা, খুলনা

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ১৩ জুন ২০২৫

পাইকগাছায় ডিঙি নৌকায় কপোতাক্ষে ভাসমান সুখেন-অন্নার জীবনসংগ্রাম

চোখে মোটা গ্লাসের চশমা, তবুও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। যেন চোখে ভাসে কেবল কিছু অস্পষ্ট আলোর রেখা—জলের আয়নায় আটকে থাকা একঝাঁক বিষণ্ন তারা। চুলগুলো অনেক আগেই পেকে সাদা হয়ে গেছে, চোয়ালের চামড়া কুঁচকে গেছে বয়সের ভারে। মুখশ্রীতেই লেখা প্রৌঢ়ত্বের ইতিহাস। নাম তার সুখেন বিশ্বাস। বয়স সত্তরের কোঠা পেরিয়ে গেছে। তবুও এখনও সংগ্রামী, জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক নাম।

পাইকগাছার গদাইপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া জেলেপল্লী, যাকে সবাই মালোপাড়া বলে চেনে—সেখানেই ছিল জন্ম ও শৈশব। কিন্তু কয়েক যুগ আগেই রাক্ষুসী কপোতাক্ষ নদ গিলে নিয়েছে তার বসতভিটা, সহায়-সম্বল। সেই থেকে একমাত্র সঙ্গিনী, সহধর্মিণী অন্নাদেবীকে (ছদ্মনাম) সঙ্গে নিয়ে শুরু হয়েছে তার ভাসমান জীবন—ডিঙি নৌকাই তাদের ঘর, নদই জীবন।

নদীই এখন তার ঠিকানা, তার পরিচয়। নদীর স্রোতের মতোই ভাসতে ভাসতে কাটে দিন—আজ বোয়ালিয়া, কাল আগড়ঘাটা, পরশু শিববাটি। কপোতাক্ষ, শালিখা, শিবসা—নানান নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। দিনের শেষে যতটুকু মাছ জোটে, তা বিক্রি করেই কোনোমতে চলে তাদের সংসার। কিন্তু প্রতিটি দিন সমান নয়—কখনও আধপেটা, কখনও অনাহারে রাত কাটে। বেশি সময়ই ভরসা শুধু শুকনো খাবার—চিড়া, মুড়ি আর বিস্কুট।

বৃষ্টি, রোদ, ঝড়-তুফান—কিছুই দমাতে পারেনি এই বৃদ্ধ জেলেকে। পাশে থেকে নিরন্তর সাহস জুগিয়ে যান অন্নাদেবী। তার চোখে মুখে রয়েছে গভীর প্রেমের ছায়া, যেন সন্ধ্যার নদীর স্তব্ধ কোনো প্রার্থনা। অসুস্থ হলে দু’জনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে উৎকণ্ঠা, ভয়।

শুক্রবার(১৩জুন) সরেজমিনে কথার ফাঁকে অন্নাদেবী বললেন, আমার সব ছিল—ঘরবাড়ি, গরু, বাগান, জমি। সব কিছু ওই রাক্ষুসী নদী কেড়ে নিয়েছে। এটা আমার ভাগ্য। এখন জীবনের শেষবেলায় সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা—সাখা সিঁদুর নিয়েই যেন মরতে পারি। তার ছলছলে চোখ তখন নদীর মতোই গভীর।

তাদের একমাত্র মেয়ে এখনও মালোপাড়াতেই থাকে। মাঝেমধ্যে বুকের টানে তারা সেখানে ছুটে যান। আজ হঠাৎ নদীপাড়ে দেখা হয়ে গেল এই জীবনসঙ্গী দম্পতির সঙ্গে। কথার ফাঁকে হঠাৎ সুখেন বিশ্বাস বললেন, বাবু, কথা বলতে ভালো লাগছে, কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখন আর নদীতে আগের মতো মাছ মেলে না, যেতে হবে অনেক দূরে। যদি বেঁচে থাকি, আবার কথা হবে।

এইভাবেই দিনরাত নদীর বুকে লড়াই করে চলেছেন তারা। মাথার উপর নেই ছাদের নিশ্চয়তা, পাশে নেই কেউ—নেই কোনো আপনজন। একসময় সরকারের দেওয়া ঘরের আশায় আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তদবির আর অন্যদের ভিড়ে তাদের ভাগ্যে কিছু জোটেনি। আজ শরীর আর আগের মতো সাড়া দেয় না, মাছ ধরাও হয়ে উঠেছে কষ্টকর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার ভেঙে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস।

তবুও তারা লড়ে যাচ্ছেন—ভেসে যাচ্ছেন নদীর স্রোতের মতো।
সুখেন বিশ্বাস—শুধু একটি নাম নয়,
একটি শব্দ,
যার প্রতিধ্বনি এখনো কপোতাক্ষের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলে,
যেমন বয়ে চলে কোনো পুরোনো বেদনার নিঃশব্দ প্রবাহ।

Jahan

×