
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে যশোর রোড নিছক একটি সড়ক নয়—এটি একটি জীবনচিত্র, একটি সময়ের স্বাক্ষর। শতবর্ষ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াঘেরা বৃক্ষরাজি আর ধুলোবালি মাখা পথ যেন ইতিহাসের এক জীবন্ত উপাখ্যান বলে চলে আমাদের। যশোর শহর থেকে শুরু হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের মধ্যে বাংলাদেশ অংশ পড়েছে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার, যা আমরা যশোর-বেনাপোল সড়ক নামে চিনি। বাকিটা ছুটে গেছে পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ, হাবড়া, বারাসাত ছুঁয়ে কলকাতা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে।
১৮৪০-এর দশকে ঐতিহাসিক এই পথের জন্ম হয়েছিল এক নিখাদ মাতৃভক্তির গল্পে। যশোর শহরের জমিদার কালীপ্রসাদ পোদ্দারের মা যশোদা গঙ্গাস্নানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু নৌযাত্রার অসুবিধার কারণে যেতে পারেন না। এই অনাদরে কষ্ট পেয়ে যশোদা দেবী অনশনে বসেন। তখন কালী পোদ্দার যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ব্যয়ে কয়েক হাজার শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রমে ১৮৪২ সালে সম্পূর্ণ হয় সড়কটির নির্মাণকাজ। সেই রাস্তাকেই পরে 'যশোর রোড' বলা হয়। এই গল্পটি শুধু একটি রাস্তা নির্মাণের নয়, এটি এক মহীয়সী নারীর বিশ্বাস এবং এক পুত্রের ত্যাগের ইতিহাস।
যশোর রোড শুধু একটি যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না; এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের লাখো মানুষের স্বপ্ন, ভয়, কান্না আর প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। ১৯৭১ সালের সালে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার মুখে জীবন বাঁচাতে লাখো বাঙালি যখন দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, তখন যশোর রোড হয়ে ওঠে নির্ভরতার পথ। ট্রেন কিংবা গাড়ি দূরের কথা, লক্ষ লক্ষ মানুষ এই দীর্ঘ সড়ক পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে কেবল একটুখানি নিরাপত্তা আর আশ্রয়ের আশায়। কাঁদা, বৃষ্টি আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কিছু মানুষ পৌঁছাতে পেরেছে সীমান্তের ওপারে, কিন্তু অনেকে পথেই মারা গেছে—ক্ষুধা, রোগ, ক্লান্তি কিংবা বোমার আঘাতে।
মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে কলকাতার শরণার্থী শিবিরে গিয়ে এই সড়কের উপর দাঁড়িয়ে লাখো মানুষের সেই কষ্ট, কান্না ও যন্ত্রণার সাক্ষী হন। পরে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখেন বিখ্যাত কবিতা 'September on Jessore Road'। সেই কবিতা কেবল শব্দ নয়, হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবিক বিপর্যয়ের আন্তর্জাতিক প্রতিচ্ছবি। কবিতার একাংশে তিনি লেখেন—
"Millions of babies watching the skies,
Bellies swollen with big round eyes"
যশোর রোডের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন দিক হলো এই সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী রেইনট্রি গাছগুলো। যেগুলো নিছক বৃক্ষ নয়—প্রতিটি গাছ যেন একটি করে ইতিহাস। বাংলাদেশের যশোর অংশে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই গাছগুলো আজও পথচারীদের ছায়া দেয়। এদের ডালে এখনও জড়িয়ে আছে বহু শরণার্থীর কান্না, বহু মায়ের স্তব্ধতা, বহু মুক্তিযোদ্ধার পদচিহ্ন।
এই গাছগুলোর সংরক্ষণ নিয়ে যদিও মাঝে মধ্যে নাগরিক ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তবে সরকারিভাবে এই ঐতিহ্য রক্ষায় দৃশ্যমান উদ্যোগ কমই দেখা গেছে।
বাংলাদেশ অংশে এই ঐতিহাসিক সড়কটির নাম এখন কেবল “যশোর-বেনাপোল সড়ক”। রাস্তার পাশে দোকান, রেস্তোরাঁ বা বাস স্ট্যান্ড কোথাও “যশোর রোড” লেখা নেই। অথচ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের অংশে আজও এটি “Jessore Road” নামে খ্যাত এবং নানা স্মৃতিফলকে তার পরিচয় লিপিবদ্ধ। বাংলাদেশের ইতিহাসের এত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বহন করেও এই সড়কের নামকরণ নিয়ে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ।
স্হানীয় প্রবীণেরা বলেন, “এই সড়ক কেবল যোগাযোগের পথ নয়, এটি একটি আন্দোলনের ইতিহাস। নামহীন থাকা মানেই আমাদের ইতিহাসকে অস্বীকার করা।” মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান বলেন, “এই রাস্তায় আমরা হেঁটেছি ভয় আর প্রতিজ্ঞা নিয়ে। এই সড়কের প্রতিটি ধুলোবালির মধ্যে রক্ত ও আত্মত্যাগ মিশে আছে। একটি স্মারক বা গেট তো থাকা উচিতই।”
ঝিকর কাছে উপজেলার বাসিন্দা শেখ এনামুল ইসলাম বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না এই সড়কের গৌরবগাথা। কেউ চেনে না জমিদার কালী পোদ্দারকে, কেউ জানে না এই রাস্তায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া শিশুদের কথা। অথচ এই রোড ঘিরেই কত কবিতা, গান, স্মৃতি আর আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ। গবেষক, লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠকদের এগিয়ে আসা দরকার। সড়কের পাশে নির্মাণ করা যেতে পারে একটি ছোট্ট যাদুঘর বা স্মারক ফলক, যেখানে থাকবে ইতিহাসের বিবরণ, মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য আর সেইসব কান্নাজড়ানো গল্প।
যশোর রোড বাঙালির ইতিহাসের এক অন্তঃস্রোত। এর ধুলোমাখা পথ যেন বহন করে যুগ যুগান্তরের কান্না, আশা ও সংগ্রাম। ইতিহাসের এই অনন্য সড়কটির প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো স্মৃতি রক্ষা, নামকরণ এবং যথাযথ মর্যাদা প্রদান। কারণ, যে জাতি তার ইতিহাস ভুলে যায়, তার ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়ে—আর যশোর রোড ঠিক সেই ইতিহাসের একটি নির্মল আয়না, যার দিকে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি, আমরা কোথা থেকে এসেছি, এবং কী হারিয়ে ফেলেছি।
Jahan