কামাল আহমেদ। বাংলাদেশের বরেণ্য একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। পাবনার সন্তান কামাল আহমেদ পেশায় বাংলাদেশ বেতারের একজন উর্ধ্বতন (বহির্বিশ্ব কার্যক্রম বিভাগ) কর্মকর্তা। এ পর্যন্ত তার ১৫টি এ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। সঙ্গীতচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ গান গেয়ে দেশে বিদেশে সম্মানিত হয়েছেন। তার সঙ্গীত সাধনা এবং পেশাগত জীবনের নানা দিক নিয়ে তার সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয়।
সঙ্গীত অঙ্গনে পদার্পণে ছোটবেলার কথা জানতে চাই।
কামাল আহমেদ : আমার জন্ম পাবনার নিভৃতপল্লী খোঁকড়া গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছি গ্রামের এক স্কুলে। তারপর পাশের গ্রামে এক হাইস্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা। সেই স্কুলের নামটি ছিল ‘বাঁশের বাদা উচ্চ বিদ্যালয়’। এই স্কুলে পড়ার সময়েই একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাই। গান-বাজনা করার সুযোগ পাই। তখন আমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারতাম না, খালি গলায় গান করতাম। গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম, আর সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করলামÑ ভাল লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাল গানও আমাকে গাইতে হবে। এসএসসি পর্যন্ত গ্রামেই কেটেছে আমার। খুব রেডিও শুনতাম, গান শুনেই তা গাইবার চেষ্টা করতাম। ক্লাস এইটে পাওয়া স্কলারশিপের টাকা দিয়ে বাবার অজান্তেই একটা হারমোনিয়াম কিনলাম। হারমোনিয়ামটা বাসায় না এনে অন্য বাসায় রেখে দিলাম। তারপর আমি পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছায়ানটে ভর্তি হই। এই আমার সঙ্গীতের পথ চলা শুরু।
এ পর্যন্তটি আপনার কয়টি এ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে?
কামাল আহমেদ : এ আমার পর্যন্তটি গানের এ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের এ্যালবাম ‘সাদা মেঘের ভেলা’ ‘নানা রঙের দিনগুলি’ , ‘পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, ‘ফাল্গুনের দিনে’, ‘বালুকা বেলায়’, ‘নিদ্রাহারা রাতের গান’, ‘দূরের বন্ধু’, ‘নিঃশব্দ চরণে’ ( মিক্সড এ্যালবাম),, ‘বেঁধেছি আমার প্রাণ’, ‘গোধূলি’ (হারানো দিনের গান), ‘কান পেতে রই’, ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়’, ‘অধরা’ (আধুনিক গান), ‘গানের তরী’ (তিন কবির গান) এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত গানের এ্যালবাম ‘মহাকাব্যের কবি’ অন্যতম।
বর্তমানে বেতারে যে দায়িত্বে আছেন তার কাজের পরিধি কেমন? কী ধরনের কাজ করতে হয়?
কামাল আহমেদ : আমি বর্তমানে বহির্বিশ্ব কার্যক্রম, বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছি। ‘বহির্বিশ্ব কার্যক্রম’ বাংলাদেশ বেতারের একটি স্বতন্ত্র ইউনিট। কার্যক্রমটি বাংলাদেশের অডিও দূত হিসেবে কাজ করে। প্রবাসী ও বিদেশী শ্রোতাদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ, বিশ্বের বিভিন্নœ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও শান্তি বজায় রাখতে বাংলাদেশে বৈদেশিক নীতিসমূহের বাস্তবায়নে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে এ ইউনিটটি সম্প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলা, ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, উর্দু ও নেপালী এ ৬টি (ছয়) ভাষায় ৮টি অধিবেশনে দৈনিক সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিট থেকে রাত ২টা পর্যন্ত প্রচার হয়।
সঙ্গীত চর্চায় কতগুলো সম্মাননা পেয়েছেন?
কামাল আহমেদ : এ পর্যন্ত আমি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৫টি (পাঁচ) পদক লাভ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ‘সার্ক কালচারাল সোসাইটি এ্যাওয়ার্ড ২০১০’, ‘বঙ্গবন্ধু গবেষণা ফাউন্ডেশন এ্যাওয়ার্ড ২০১৫’, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ এ্যাওয়ার্ড, মহারাজা বীর বিক্রম বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত (২০১৭)’, ‘বীর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ্যাওয়ার্ড, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত (২০১৭)’, ‘ফোবানা এ্যাওয়ার্ড, কানাডা (২০১৭) প্রভৃতি।
বিদেশেই বেশি সম্মাননা পেয়েছেন ?
কামাল আহমেদ : দেশের চেয়ে বিদেশেই বেশি সম্মাননা পেয়েছি। আমার এ পর্যন্তটি গানের এ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ নম্বর এ্যালবাম ‘দূরের বন্ধু’ এবং ১৫ নম্বর এ্যালবাম বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত গান নিয়ে এ্যালবাম ‘মহাকাব্যের কবি’ কলকাতার রাগা মিউজিক থেকে প্রকাশিত হয়। আমার মূল্যায়নে আমার ১৫টি এ্যালবামের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত গান নিয়ে এ্যালবাম ‘মহাকাব্যের কবি’। শুধু তাই নয় এই এ্যালবাম প্রকাশের আগেরদিন অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট তারা টেলিভিশনের ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে ‘মহাকাব্যের কবি’ এ্যালবাম নিয়ে কথা বলি এবং এই এ্যালবামের সঙ্গীত পরিবেশন করি। যা সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী দর্শক শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যায় এবং এ বিষয়টি তারা জানতে পারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন বাঙালী কণ্ঠশিল্পীর এটিই প্রথম একক এ্যালবাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম একক এ্যালবামে বেশ সাড়া পেয়েছি। যার মাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আমার একটি বিশ্বায়ন ঘটে। এছাড়া ভারতের কলকাতা, আগরতলা, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড ও কানাডায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের বাইরে আমার একটি পরিচিত আসে। এ কারণেই দেশের চেয়ে দেশের বাইরে থেকে সম্মাননার প্রাপ্তি বেশি।
বাংলাদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা এবং এর প্রসারে সংগঠন বা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম কতটা ইতিবাচক?
কামাল আহমেদ : বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা ও এর প্রসারে সংগঠন বা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম খুবই ইতিবাচক। বাংলাদেশের রবীন্দ্রসঙ্গীতের পথিকৃৎ ওস্তাদ ওয়াহিদুল হক প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্তও সংস্থার কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে।সংস্থাটি নিরন্তরভাবে শুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা ও লালন প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থাও রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসারে দেশব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের তুলনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার কার্যক্রম কিছুটা সীমিত। তবে দুটি সংস্থা মিলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছড়িয়ে দিতে অনেকাংশে সক্ষম হচ্ছে। এ দুটি সংগঠনের পাশাপাশি আরও সংগঠন এ কার্যক্রমে যুক্ত হলে বিষয়টি আরও সফল হবে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে নতুনদের আগ্রহ কেমন? তাদের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য কী?
কামাল আহমেদ : রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে বাঙালী পরিবারের নতুন প্রজন্মের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। যে সকল পরিবারের জীবনাচরণে বাঙালীয়ানা অনুপস্থিত সে সকল পরিবারের নতুন প্রজন্মের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ কিছুটা হলেও কম। আমি তাদের উদ্দেশে এটুকুই বলতে চাই, সফল এবং সার্থক বাঙালী হিসেবে গড়ে উঠতে হলে রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টিকে জানার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনাকেও জানা প্রয়োজন।
সঙ্গীত চর্চা বা আপনার ক্যারিয়ার নিয়ে ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনা কী?
কামাল আহমেদ : ক্যারিয়ারের জন্য সঙ্গীত চর্চা করি না। চর্চা করি ভালবাসা এবং তাগিদ থেকে। তাই যতদিন সুস্থ থাকব ততদিন সঙ্গীত নিয়ে কাজ করতে চাই। রেখে যেতে চাই নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু সৃষ্টি, যা স্পর্শ করলে নতুন প্রজন্ম কিছুটা হলেও বাঙালী সংস্কৃতি ও সামনে চলার পথ খুঁজে পাবে।
-সাজু আহমেদ