
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। দেশের লক্ষ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যে অর্থ দেশে পাঠান, তা কেবল তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার মানই উন্নত করে না, বরং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও রাখে এক বিশাল ভূমিকা। রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনতে অপরিহার্য অবদান রাখে।
অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রভাব:
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি: রেমিট্যান্স সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করে। এর ফলে আমদানি ব্যয় মেটানো, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একটি শক্তিশালী রিজার্ভ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলায় সহায়তা করে।
- দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: প্রবাসীরা তাদের উপার্জনের একটি বড় অংশ পরিবারের কাছে পাঠান। এই অর্থ গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্র পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান নির্মাণ এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এই অর্থের ব্যবহার দারিদ্র্য কমাতে সাহায্য করে।
- ভোগ বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি: রেমিট্যান্সের অর্থ দেশে পৌঁছালে তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায়, যার ফলে অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত ভোগ দেশীয় পণ্যের চাহিদা তৈরি করে এবং শিল্প উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রসারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- বিনিয়োগ বৃদ্ধি: রেমিট্যান্সের একটি অংশ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয়। কেউ কেউ জমি কেনা, বাড়ি তৈরি করা, ছোট ব্যবসা শুরু করা বা কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন। এই বিনিয়োগগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখে।
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: যদিও সরাসরি রেমিট্যান্স কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না, তবে রেমিট্যান্স-নির্ভর বিনিয়োগ এবং ভোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে অসংখ্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। নির্মাণ খাত, কৃষি, ছোট ও মাঝারি শিল্প (SME) এর অন্যতম উদাহরণ।
- গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন: বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি পায় এবং সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
রেমিট্যান্সের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি:
যদিও রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ, এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
- হুন্ডি ও অবৈধ চ্যানেল: রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহার একটি বড় সমস্যা। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রাজস্ব হারায় এবং প্রবাসীরাও প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
- অভিবাসন ব্যয়: বিদেশে যাওয়ার জন্য অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি, যা অনেক পরিবারকে ঋণগ্রস্ত করে তোলে। এই উচ্চ ব্যয় প্রবাসীদের আয়ের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করে ফেলে।
- শ্রমবাজারের অনিশ্চয়তা: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, তেলের দামের ওঠানামা বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
- দক্ষ শ্রমিকের অভাব: অদক্ষ শ্রমিকরা তুলনামূলকভাবে কম মজুরি পান এবং তাদের জন্য ভালো সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়। দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানো গেলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
- বিনিয়োগের অভাব: রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ অনুৎপাদনশীল খাতে (যেমন জমি ক্রয়, বিলাসবহুল দ্রব্য) ব্যয় হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তেমন অবদান রাখে না।
ভবিষ্যৎ পথ:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদানকে আরও সুসংহত করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করা: অবৈধ হুন্ডি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ ও লাভজনক করা।
- অভিবাসন ব্যয় হ্রাস: অভিবাসন ব্যয় কমানো এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
- দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি: বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর ওপর জোর দেওয়া, যাতে তারা উচ্চ মজুরি পেতে পারে।
- রেমিট্যান্সের উৎপাদনশীল ব্যবহার: প্রবাসীদের রেমিট্যান্স উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে।
- প্রবাসীদের কল্যাণ ও অধিকার সুরক্ষা: বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি স্তম্ভস্বরূপ। এটি কেবল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় না, বরং দারিদ্র্য বিমোচন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে, এই বহুমুখী সুবিধা নিশ্চিত করতে এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রবাসী শ্রমিকদের যৌথ প্রচেষ্টা অপরিহার্য। রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদনশীল ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
সাব্বির