ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ বিকেলের বাণিজ্যমেলা

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০১:২৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

শেষ বিকেলের বাণিজ্যমেলা

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বেশ জমজমাট বাণিজ্যমেলা

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বেশ জমজমাট বাণিজ্যমেলা। দ্বি-প্রহরে বাংলামোটর থেকে রওনা দিয়ে দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাক্সিক্ষত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায়। যাওয়ার প্রস্তুতি ভাবনা যতটা কঠিন ছিল গন্তব্যে পৌঁছানো ঠিক ততটাই সহজ মনে হলো। মেলার প্রবেশ ফি জনপ্রতি ৪০ টাকা, ছোটদের জন্য ২০ টাকা। অনেক বড় পরিসর সত্ত্বেও লোকে লোকারণ্য। বাইরে থেকে চাকচিক্য না লাগলেও ভিতরটা খুব পরিপাটি।

গত বছর মেলায় যাওয়ার রাস্তাটা তেমন ভালো ছিল না এবং মেলার ভিতরে স্টলের সংখ্যাও কম ছিল। এবারের মেলায় ¯টল সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ক্রেতা ও দর্শনার্থীও অনেক। গতবারের মতো প্রবেশদ্বার থেকে একটু সামনে আগালেই দেখা যায় চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র, তথ্য কেন্দ্র এবং পুলিশ কন্ট্রোল রুম।

ভিতরে প্রশস্ত ফাকা জায়গা এবং চারদিকে ছড়ানো ছোট-বড় প্যাভিলিয়ন। বাণিজ্যমেলার অন্যতম আকর্ষণ কাশ্মীরী শালের স্টলে চোখ পড়তেই দেখা গেল তিনজন কাশ্মীর প্রবাসী বিক্রেতা, তারা এসেছেন শুধু এই মেলা উপলক্ষে। নান্দনিক শালে ভরপুর তাদের দোকান। বিগত দশ বছর ধরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ করছেন। এরকম আরও কিছু স্টল রয়েছে যারা সরাসরি সুদুর কাশ্মীর থেকে এসেছেন মেলা উপলক্ষে। তবে তারা গত বছর  আসেননি।

এবারই প্রথম নতুন জায়গায় এ মেলায় অংশগ্রহণ করা। যদিও আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষই দর্শনার্থী বলে জানালেন তারা। ক্লাসিক হোমটেক্সের এক বিক্রেতা বললেন, আগে যেভাবে মেলায় বিক্রি হতো এখন সেভাবে হচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষ দেখে চলে যায়। এখানে আসা বেশিরভাগ লোকজনই আশপাশের এলাকার। তারা এখানে আসে ঘুরতে। তবে স্টলের অনেক বিক্রেতাই আশা প্রকাশ করেছেন, ধীরে ধীরে এ মেলা অনেক জমবে এবং বিক্রিও বাড়বে।

যেহেতু গতবারের তুলনায় এবার লোকজন অনেক বেশি আসছে একই সঙ্গে বেড়েছে বিক্রিও। অন্যদিকে ঘরের আসবাবপত্র বা ফার্নিচারের স্টলগুলোতে যা ছিল তা সবারই নজর কাড়বে। প্রতিটি সোফা সেট ও ফার্নিচারগুলো ছিল চোখ ধাঁধানো। একটির চেয়ে একটি আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। তার্কিস একটি প্যাভিলিয়নে গিয়ে দেখা যায় বাহারী রং ও ডিজাইনের কার্পেট। এতটা সুন্দর যে সবাই পছন্দ করবে। এগুলোর দাম একটু বেশি হলেও মান অনেক ভালো।

থ্রিপিছ ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যে বরাবরের মতোই ছিল মূল্য ছাড়সহ নানা রকম অফার। নামি-দামি অনেক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল কিছু ছোট ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠান। ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, রাইস কুকার, ব্লেন্ডার এবং রুম হিটারসহ নানা রকম পণ্যের রয়েছে স্পেশাল অফার। ওয়াশিং মেশিনের সঙ্গে ২৫ টি পণ্য আবার ওভেন কিনলে পাওয়া যাবে ১০ টি পণ্য। ওয়ালটন, মিনিস্টারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের শো-রুম ছিল একই প্যাভিলিয়নে। ওয়ালটন থেকে জানা গেল পরবর্তী মেলায় তারা আগের মতোই আলাদা প্যাভিলিয়ন করবে। রাজধানী শহর থেকে বেশ দূরে মেলার স্থান হওয়াতে আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না তবে এই পরিস্থিতি একসময় ঠিক হয়ে যাবে বলেই বিক্রেতাদের বিশ্বাস।

নানা পণ্যে ভরপুর বিভিন্ন স্টলের মধ্যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দিয়ে সাজানো ‘কাল্ব রিসোর্ট অ্যান্ড কনভেনশন’ নামের একটি দোকানে গিয়ে কথা হলো কলেজ শিক্ষার্থী লোপার সঙ্গে। নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজে পড়ছেন। মেলায় এসেছেন খ-কালীন চাকরি করতে। দৈনিক এক হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। তিনি সেখানে ২০ দিন চাকরি করার জন্য এসেছেন। তবে অধিকাংশ ছেলেমেয়ে ৩০ দিনের চুক্তিতেই চাকরি করছেন।

প্রতি বছরই এ সময়ে বহু শিক্ষার্থী এখানে খ-কালীন কাজ করেন। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুলের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন সেখানে। নিউ টেনে পড়া মারিয়া এবং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মনি কসমেটিকসের স্টলে চাকরি করছেন মাসব্যাপী চুক্তিতে। প্রতি বছরই এরকম বহু শিক্ষার্থী এ সময়ে বাড়তি রোজগারের সুযোগ পায়। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে পড়তে যায় তাদের অধিকাংশই এভাবে পার্টটাইম জব করে নিজেদের খরচ চালায়। তবে দেশে এটা এখনো তেমন দেখা যায় না।

আবার অভিভাবকরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান ঠিক রাখতেও সন্তানদের এমন কাজে সমর্থন করেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করলেও ছেলে-মেয়েদের চাকরির আগ পর্যন্ত কোনো পার্ট টাইম জব করতে দেয় না। তাই সকলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো একান্ত প্রয়োজন। কোনো কাজ ছোট নয়। আজকাল বড় বড় সুপার শপে শিক্ষার্থীদের দেখা গেলেও তা খুবই নগণ্য।
এবারের ডিআইটিএফের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রায় অর্ধকোটি টাকা দিয়ে তৈরি পরি পালং খাট। বানিয়েছেন খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. নুরুন্নবী। ছয় লাখ টাকা দিয়ে স্টল নিয়েছেন। দাম চাইছেন ১ কোটি, ইতোমধ্যে ৬০ লাখ টাকা দিতে রাজিও হয়েছেন কয়েকজন। এছাড়াও ক্যাশলেস লেনদেনে ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাক।

টিকিট বিক্রয় থেকে শুরু করে পণ্য কেনাকাটা সবক্ষেত্রেই রয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশের এই লেনদেন সুবিধা। নতুন ভেন্যুতে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় সিঙ্গাপুর, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, তার্কিস, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১০ টি দেশের ব্যবসায়ীরা ১৭ টি স্টলে তাঁদের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। রয়েছে দেশ-বিদেশের ৩৩১ টি স্টল, প্যাভিলিয়ন ও মিনিপ্যাভিলিয়ন, যা গত বছরের চেয়ে ১২৬ টি বেশি।

নানা রকম পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন, রপ্তানি বাজার অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন দেশের ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে এ মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিল্পপণ্য ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারীরা একদিকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান, ডিজাইন, প্যাকেজিং ইত্যাদি প্রদর্শন ও বিপণন করতে পারেন, অন্যদিকে পারস্পরিক সংযোগ স্থাপনসহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ লাভ করে। 
উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি বাণিজ্যমেলা। এরপর ২০২২ সাল থেকে নতুন স্থানে শুরু হয়েছে এ মেলা। গতবারের ন্যায় এবারও ঢাকার পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে মাসব্যাপী ২৭ তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা (ডিআইটিএফ)-২০২৩ হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর যৌথ উদ্যোগে  মেলার আয়োজন।
বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের যুগে প্রতিযোগিতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে হলে দেশের পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলার জন্য আমাদের রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই পণ্য উন্নয়ন, বহুমূখীকরণ ও বিপণনে দক্ষতা অর্জনসহ প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ডিআইটিএফ-২০২৩ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেই আশা করা যায়।

×