রহিম শেখ ॥ স্থায়ীভাবে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ পরিবর্তিত নাম ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বিশেষায়িত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের। ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন, ২০১৪ (২০১৪ সালের ৭নং আইন) এর আওতায় ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুবিধাবঞ্চিত পল্লী এলাকার দরিদ্র মানুষদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা। অন্য অনেক ব্যাংকের চেয়ে এ ব্যাংকের আকার বড়, জনবলও বিশাল। বর্তমানে মোট ৪৯০টি শাখা রয়েছে সারা দেশে। এতগুলো শাখা নিয়ে আর কোন বিশেষায়িত ব্যাংক নেই। প্রায় ১১ হাজার জনবল নিয়ে ব্যাংকটি চলছে। ব্যাংকটির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন খন্দকার আতাউর রহমান। জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, যেহেতু প্রকল্প থেকে রূপান্তরিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, ফলে এখানে চ্যালেঞ্জগুলো একটু অন্য ধরনের। প্রকল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারী নিয়ম সবক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় না। অস্থায়ীভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা হয়েছে। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সমস্যা প্রশমিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের কোন অডিট ছিল না। কিন্তু যেকোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাজের পেছনে পেছনে অডিট থাকে। এখানে তেমন কোন অডিট ছিল না। আমি যোগ দেয়ার পরে একটি অডিট টিম গঠন করলাম। আমার জানা দরকার ছিল, এতগুলো টাকা এখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সে টাকাগুলো কি অবস্থায় রয়েছে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে- ১১ হাজার জনবল হলেও সবাই মাঠপর্যায়ে কাজ করে। কর্মকর্তার সংখ্যা খুবই কম। অর্থাৎ সুপারভিশন যারা করবে তারা নেই বললেই চলে। এখানে সিনিয়র অফিসার হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এরপর একজন জি এম রয়েছেন। এরপরের অবস্থানেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মাঝে কোন গ্যাপ নেই। আমি আসার পরে ১৮টি অডিট টিম তৈরি করেছি। এ পর্যন্ত ২৩৭টি শাখায় অডিট সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলো চলমান রয়েছে। অডিট করতে গিয়ে যেসব অনিয়ম উঠে এসেছে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। টাকা আদায় করে যে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকে জমা দিতে হয়, এ ধারণা প্রকল্পের লোকজনের মধ্যে নেই। অডিট চলাকালীন আমরা প্রচুর টাকা আদায় করতে পেরেছি। এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রতিটি গ্রামে ব্যাংকের উদ্যোগে গ্রাম সমিতি গঠন করে সমিতির সদস্যদের দৈনিক সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা এবং আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ঋণ ও এসএমই ঋণ প্রদান করাই ব্যাংকের প্রধান কার্যক্রম। সমিতির বিশেষত্ব হচ্ছে প্রতিটি সমিতিতে ৬০ জন সদস্যদের মধ্যে ন্যূনতম ৪০ জন মহিলা সদস্য। এ যাবত এ রকম প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার সমিতি ব্যাংকের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে যার সদস্য সংখ্যা প্রায় সাতান্ন লক্ষ। অর্থাৎ এই ১ লক্ষ ২০ হাজার সমিতির ৫৭ লক্ষ পরিবার সরাসরি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। সঞ্চয়ী সেবার মধ্যে আছে ৩, ৫ ও ১০ বছর মেয়াদী পল্লী পেনশন স্কিম যেখানে মুনাফার হার ৭ শতাংশ, শিক্ষার্থী আমানত স্কিম বা স্কুল ব্যাংকিং উৎসাহিত করার জন্য মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে হিসাবধারী ছাত্র-ছাত্রীদের পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসিতে প্রাপ্ত সিজিপিএর ওপর অর্থাৎ প্রাপ্ত সিজিপিএর দ্বিগুণ হারে মুনাফা প্রদান করা হয়। আর আছে সঞ্চয়ী হিসাব যা আবশ্যিকভাবে সমিতির প্রত্যেক সদস্যকে সঞ্চয়ের জন্য খুলতে হয়। এখানে আকর্ষণীয় মুনাফা দেয়া হয়। ঋণ সেবার মধ্যে আছে ক্ষুদ্র ঋণ, এস এমই-ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ যার মেয়াদ এক বছর। ঋণের সিলিং পঁচিশ হাজার থেকে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত। এছাড়া আছে স্বল্পমেয়াদী শস্যগোলা ঋণ যার মেয়াদ ৩ থেকে ৬ মাস।
ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় পল্লী এলাকার উৎপাদন সেবা এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য সরকার ঘোষিত প্যাকেজের আওতায় বিশেষ কর্মসৃজন ঋণ। পল্লী এলাকায় এ্যাম্বুলেন্স ক্রয় অথবা যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে যানবাহন ক্রয়ের জন্যও ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। আমরা সুদের কথা বলি না। আমরা সেবার বিপরীতে নামমাত্র সেবামূল্য নিয়ে থাকি যার হার ৪% থেকে ৮% এর মধ্যে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সকল দরিদ্র গ্রাহক পল্লী এলাকায় বসবাস করেন যাদের পক্ষে উপজেলায় এসে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করা অসুবিধাজনক তাই ব্যাংকের সেবা এসব গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ব্যাংক মোবাইল ফোন ভিত্তিক ডিজিটাল আর্থিক সেবা ‘পল্লী লেনদেন’ চালু করেছে। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে ‘পল্লী লেনদেন’ এর কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, শুরু থেকে এ যাবত পর্যন্ত যদি বলি তাহলে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে যার উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। অর্থাৎ এক কোটি দরিদ্র মানুষ নিজেদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত নন-সিডিউল ব্যাংক হওয়ায় আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে এ ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের সুযোগ নেই। শুধুমাত্র ব্যাংকের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম সমিতির সদস্য এবং তাদের পরিজনদের আমানত ব্যাংক সংগ্রহ করে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সংগৃহীত আমানতের স্থিতি ২,৭৬৯ (দুই হাজার সাতশত ঊনসত্তর) কোটি টাকা।