ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজকের সঞ্চয়ই ভবিষ্যতের ভরসা

সুমন্ত গুপ্ত 

প্রকাশিত: ০১:২২, ১২ মার্চ ২০২৩

আজকের সঞ্চয়ই ভবিষ্যতের ভরসা

বিপদের দিনে বড় সম্পদ হতে পারে সঞ্চয়

বিপদের দিনে বড় সম্পদ হতে পারে সঞ্চয়। সেভিংসের গুরুত্ব আজ নয়, বহু আগে ঘরে ঘরে মা-ঠাকুরমা-দিদিমারাই শিখিয়েছেন, মাটির ব্যাংকে একটু একটু করে পয়সা জমানো। মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। কাগজি নোটের (ব্যাংক নোট) ব্যবহারও কয়েক শতাব্দী হয়ে গেছে। শুরুতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ অর্থকড়ি সঞ্চয় করত মাটি বা পিতলের কলসিতে। সেই কলসি ঘরে বা নিরাপদ কোনো স্থানে মাটির নিচে পুঁতে রাখত। কেউ বা বাঁশ ফুটো করে সেখানে অর্থ জমাত।

ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় মানুষ ব্যাংকে অর্থ জমানো শুরু করে। সময় যত এগিয়েছে, সঞ্চয়-এর কৌশলেও এসেছে বৈচিত্র্য, এসেছে নতুনত্ব। তবে গুরুত্ব আজও কমেনি। আজকের সঞ্চয়ই ভবিষ্যতের ভরসা। ভবিষ্যতের অদেখা অজানা সময়ের অনিশ্চয়তা থেকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত থাকার জন্যেই সঞ্চয়। রোজকার খরচ-খরচার পরে উদ্বৃত্ত অর্থ জমিয়ে রাখার দিন আর নেই। এখন সঞ্চয়ের পরিমাণ ধরেই মাসিক ব্যয়ের হিসাব করতে হবে। আর এই অভ্যাস শুরু করতে হবে জীবনের গোড়ার দিকেই।

আমরা শুনেছি, আগেকার দিনে মায়েরা রান্নার চাল নেওয়ার সময়ে কুল দেবতার নাম করে এক মুঠো তুলে রাখতেন অন্য একটি পাত্রে। মাসের শেষে, রোজ একটু করে তুলে রাখা ওই চালই অভাবের সংসারে ভাতের যোগান দিত। এটিও সঞ্চয়ের এক সহজপাঠ। ঠিক এভাবেই চিরাচরিত প্রথায় বাড়িতে মাটির ভাঁড় রেখে তাতে পয়সা জমানোর অভ্যেস ছিল মানুষের। কিন্তু সামান্য প্রয়োজনেই সেই মাটির ভাঁড় ভেঙে ফেলা যেত এবং সহজেই জমানো পয়সা খরচ হয়ে যেত।
তাই সঞ্চয়ের জন্যে টাকা জমানো উচিত ব্যাংকে। নিরাপদে বাড়তে থাকবে সঞ্চিত অর্থ।

আর এই জমানো অর্থই একদিন হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের পুঁজি। সেই পুঁজি একদিকে যেমন সংকটকালে আর্থিক সহায়তা দেবে, তেমনই আবার নতুন ব্যবসা শুরু করার মূলধন হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। ঋণ নেওয়ার সময়ে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে, যে ব্যক্তিগত পুঁজি ব্যাংকে দেখানোর দরকার হয়, সেক্ষেত্রেও উপকারে আসবে এই সঞ্চয়। মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারে আমরা দেখেছি, সাংসারিক অনটনে বা কোনো জরুরি অবস্থায় বিষয়-সম্পত্তি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়।

সময়মতো সঞ্চয় শুরু করতে পারলে, সেই সঞ্চিত অর্থ পরিবারের সম্পত্তি বা বসতবাড়িকে বিক্রি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সর্বোপরি, সমগ্র পরিবারটিকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এই সঞ্চয়ের সুঅভ্যাস শুরু করতে হবে শৈশব থেকেই। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা থাকতে পারে-এখনো চাকরি করা শুরু করিনি, এখনই কিসের টাকা জমানো? টাকা উপার্জন করা শুরু করি, তারপর জমানোর বিষয়টা দেখা যাবে। আবার এমন হতে পারে, কেবল চাকরি শুরু করেছি, কয়েক বছর যাক, তারপর জমানো শুরু করব। এই করে করে অনেকটা সময় চলে যায়; কিন্তু জমানো আর শুরু হয়নি।

এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বাড়তে থাকে এবং আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচের পরিমাণও বাড়তে থাকে। কয়েক বছর আগে টাকা জমানো যতটা সহজ হতো, এখন দিন দিন ততটাই অসম্ভব মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনি জীবনের যে ধাপেই থাকুন না কেন, আপনার কাছে অসম্ভব মনে হলেও যখনই হাতে কিছু টাকা রয়ে যাবে, তা-ই সঞ্চয় করে ফেলুন। এক সময় দেখবেন, আপনার বেশ টাকা জমে গেছে। তাই একবার শুরুটা করুন, পরে এটা চলতেই থাকবে। 
সঞ্চয়ের সহজ কৌশল
মাসিক বাজেট তৈরি : পারিবারিক বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে বাজেট তৈরি করা যেতে পারে। যেমনÑ এক মাসে কতটুকু খরচ করবেন, তা নির্ধারণ করে রাখলেন। যে জিনিসটি চলতি মাসে না কিনলেও চলবে, তা পরের মাসের জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে মাসিক একটা বাজেট তৈরি করে নিতে হবে। এই বাজেটটি তৈরি করবেন স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মিলে যেন বাজেট অনুসারে চলতে কোনো সমস্যা না হয়।
কেন সঞ্চয় করবেন : মানুষের জীবনে বিপদ-আপদ বলে কয়ে আসে না। যেমনটি গত এক বছর আগে করোনাভাইরাস পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। এই মহামারিতে আর্থিকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন প্রায় প্রতিটি মানুষ। করোনার এই স্বাস্থ্য যুদ্ধে মানুষকে যেমন ঘরের ভেতরে থাকতে হয়েছে, খেতে হয়েছে বাড়তি পুষ্টিকর খাবার। যেকোনো অসুখ-বিসুখ বা দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে বা লড়াই করতে বাড়তি টাকা প্রয়োজন। অসহায় মুহূর্তে হাত পাততে হবে না কারও কাছে।
সঞ্চয়ের লক্ষ্য স্থির : আপনি হয়তো অনেক টাকা আয় করছেন। কিন্তু ধরে রাখতে পারছেন না। তাই টাকা ধরে রাখার জন্য সঞ্চয়ের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। এখন ঢাকা ক্রেডিটসহ বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে শর্ট টার্ম ডিপোজিট, বিবাহ সঞ্চয় প্রকল্প, উৎসব সঞ্চয় প্রকল্প, বয়স্ক সঞ্চয় প্রকল্প, ত্রৈমাসিক সঞ্চয় প্রকল্প, মিলিওনিয়ার ডিপোজিট স্কিমসহ নানা ধরনের সঞ্চয় করার সুযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া ডাক বিভাগে রয়েছে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ। আপনি যদি লক্ষ্য স্থির করেন যে দশ লাখ টাকার জন্য আপনি সঞ্চয় শুরু করবেন, তাহলে আজই তা নিকটস্থ কোনো ব্যাংকে গিয়ে ডিপোজিট স্কিমের মাধ্যমে সঞ্চয় শুরু করতে পারেন। মনে রাখবেন, সঞ্চয় যত বাড়বে, আপনার মুনাফাও বাড়বে। সমৃদ্ধি ঘটবে আপনার জীবনে।
অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ না করা : সত্যি কথা বলতে কি, কেউ কেউ আছেন যারা ঋণ পাওয়াটাকে গর্বের মনে করেন। হিসাব করে দেখুন, আপনি যদি তিনটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন, তাহলে মাস শেষে ঋণ ফেরত বাবাদ আপনি কতগুলো টাকা সুদ দিয়ে থাকেন। তাই ঋণ করবেন শুধু উৎপাদনশীল খাতে, যেখান থেকে আপনি মুনাফা পাবেন। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে জন্মদিন, বিয়ে, বিবাহ বার্ষিকী, আসবাবপত্র, বেড়াতে যাওয়ার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ করবেন।

আর ব্যবসায়, কৃষি কাজে, উচ্চশিক্ষা বা ফ্ল্যাট কেনার মতো উৎপাদনশীল খাতে ঋণ করতে পারেন। ফ্ল্যাট কিনলে আপনার ভাড়া বাসায় থাকতে হবে না। ভাড়ার টাকার সঙ্গে আরও কিছু টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার ঋণের কিস্তি দিতে পারবেন। আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলে একসময় ভালো চাকরি বা ব্যবসা করে জীবনে সমৃদ্ধি আসবে।

×