ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নারী-পুরুষ সমতা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

নারী-পুরুষ সমতা

.

বৈষম্যহীন সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় সামনে এসে যায় নারী-পুরুষ সমতা। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্ত, মর্যাদা, পেশার ফারাকই নয় দৃষ্টিকটুভাবে  দৃশ্যমান হয় সমসংখ্যক নারীর পশ্চাৎপসরণ। নতুন কোনো ব্যাপার নয়। যুগ-যুগান্তরের এক অনধিগম্য যাত্রাপাথের নিরেট বাস্তবতা। সম্প্রতি পুরনো সরকার পতনের আন্দোলনে বৈষম্যরিরোধী ছাত্রদের যে সম্মিলিত অভ্যুত্থান সেখানে আবারও সাম্যের ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।  বদলে যাওয়া বাংলাদেশের নব আঙ্গিকে পুরনো অনেক জরাজীর্ণ সংস্কার সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়েও তুলছে। সাম্যবাদী চেতনায় সবার আগে প্রশ্নবিদ্ধ হয় লিঙ্গ সমতা। যা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সামাজিক বৈরিতা, অধিকারহীনতা, স্বাধীনভাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রত্যয়ও সমসংখ্যককে উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত করছে। যে কোনো ধরনের বিভাজন, বৈষম্য সমাজ ব্যবস্থার গভীরে জিইয়ে থাকে। আর নারী নির্যাতন তো সুষম সমাজের কালো চিহ্ন। তাই বরাবরের মতো এবারও নতুন আঙিকে ভিন্ন মাত্রার বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে আবারও নারী-পুরুষ সমতা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। দেশের নারী সংগঠন মহিলা পরিষদও সুউচ্চ কণ্ঠে আওয়াজ তুলছেন বৈষম্যহীনতার মূল লক্ষ্যই সমতার আদলে সারাদেশকে দৃশ্যমান করে তোলা। সেখানে চিরস্থায়ী নারী-পুরুষ প্রভেদও সমসংখ্যককে নাড়া দিচ্ছে। সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে নারীর যে অধিকার, স্বাধীনতা, অর্জন সবই বিনি সুতার মালার মতোই। কোনো ফাঁক ফোকর থাকার কথাই নয়।

সম্প্রতি পালিত হলো মহিলা পরিষদের পাক্ষিক সাংগঠনিক সম্মেলন। ১৫ দিনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উদীয়মান তরুণদের সচেতন অংশগ্রহণ দেশের আধুনিক প্রজন্মের নারী সমাজের যে দায়বদ্ধতা, একাত্মতা পরিলক্ষিত হয় সেটা এক অনন্য আনুষ্ঠানিকতা। সভা-সমিতিতে তা আরও বেগবান হয় নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ আর উৎসাহিত করবে। যা তাদের ন্যায্য দাবি, অধিকার, স্বাধীনতাকে অর্জন করতে বাধাবিঘ্নকে অতিক্রমের সোপান হবে। যে কোনো ঐতিহ্যবাহী সমাজ তার দীর্ঘদিনের সংস্কার, মূল্যবোধ আর আদর্শকে লালন-ধারণ করে এগিয়ে যায়।  সেখান থেকেই নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সূচকগুলোও দৃশ্যমান হয়। সচেতন দায়বদ্ধতায় নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলার পথকে মসৃণ করার তাগিদ অনুভব করে। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নারী সংগঠন ‘মহিলা পরিষদের প্রাসঙ্গিক, যৌক্তিক পদক্ষেপে নিজেদের শাণিত করার দৃশ্য ও স্বস্তিদায়ক। তবে আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ তৈরিতে নারীদের আরও জোরালো অংশগ্রহণ সময়ের ন্যায্যতা। সারাদেশের আনাচে-কানাচে নারী সমাজের অধিকার নিয়ে লড়াই করা ছাড়াও নির্যাতন, সহিংসতার দুর্ভোগ নিয়ে সংগঠনটি প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে থাকে। উপস্থিত সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেও এগিয়ে আসতে দেরি হয় না। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কিশোরী-তরুণীদের নিয়ে সম্মিলিত যোগসাজশে আগামীর বাংলাদেশ তৈরির মহাপরিকল্পনায় এগিয়েও আসে। তবে নারী নেতৃত্বের জায়গাটি আরও শক্তিশালী, বেগবান এবং সংখ্যা বাড়ানোও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম তার আলোচনায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। বিভিন্ন আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ  যেমন জরুরি একইভাবে গঠনমূলক, সুচিন্তিত মতামত আর হরেক সমস্যা চিহ্নিতকরণেও যৌক্তিকতার পরিচয় দেওয়া সামাজিক দায়বদ্ধতা। এমন অঙ্গীকার করা জরুরি যেখান থেকে অত্যাচার, নিপীড়নের মূল শিকড়ই উপড়ে ফেলা যাবে। রক্ষণশীল সমাজ নারীর সহজ স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দিতে বরাবরই সক্রিয় শুধু নয় প্রতিবন্ধকও বটে। তেমন শিকল সমূলে ভাঙতে হবে।

নব জোয়ার আর জাগরণে সম্মিলিত কণ্ঠ আর সচেতন কর্মযোগে দুঃসাহসী ভূমিকায় নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মূল নির্ণায়ক শক্তি সর্বমানুষের মিলন দ্যোতনা। যেখানে কোনো ফারাক, তারতম্য মাথাচাড়া দেবে না। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে সিংহভাগ গ্রামের নারীদের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টিও। বাংলাদেশ এখনো পল্লী জননীর অবারিত প্রাকৃতিক প্রতিবেশে সিংহভাগ মানুষের ছায়া দিয়ে যায়। সেখানেও নারী-পুরুষের তারতম্য এক অবধারিত দুর্ভোগ। শুধু তাই নয় স্বাস্থ্য সেবায়ও পিছিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বেদনাদায়ক। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব- সবই চিরায়ত গ্রামীণ ঐতিহ্যে প্রাসঙ্গিক কর্মযোগও অনেকটা পুরনো সংস্কারে আটকানো। গ্রামীণ ধাত্রী দিয়ে প্রসব করানোর রীতি এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আধুনিক চিকিৎসাবহির্ভূত কাজ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে, যা সংশ্লিষ্টদের দুর্ভোগের কারণই শুধু নয় বরং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াও বিরূপ পরিস্থিতির চরম দুর্ভোগ। তবে গ্রাম-গঞ্জে কমিউনিটি ক্লিনিকেরও অভাব নেই। যেখানে গর্ভকালীন সময় থেকে মাতৃত্বের শুভযোগ পর্যন্ত সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। সব জায়গায় মহিলা চিকিৎসকের সেবা গ্রহণ করতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ উঠে আসে। মহিলা পরিষদ এখানে মৌলবাদী শক্তি আর সংস্কারকে দায়ী করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয়। তবে সব সময় পুরুষতান্ত্রিকতা বিরূপ পরিবশে তৈরি করে তা কিন্তু নয়।

গ্রামীণ নারীরা নিজেও কূপম-ূকতা, কুসংস্কার, প্রচলিত চলে আসা প্রথা এমন সব বিপরীত চেতনায় আক্রান্ত থাকে। গর্ভবতী নারী সেখান থেকে বের হতেও কেমন যেন হিমশিম খায়। আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও নারী পেছনে পড়ে থাকা সমাজ ব্যবস্থারই অপসংস্কার। নিজের ব্যাপারে তো বটেই পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীর সিদ্ধান্তহীনতার ইতিবৃত্ত সেই পুরাকাল থেকে আজ অবধি দৃশ্যমান। 

×