
শিল্পকলায় শোকাবহ আগস্ট স্মরণে অনুষ্ঠিত শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে ছবি দেখছেন দর্শনার্থীরা
প্রদর্শনালয়ে প্রবেশ করতেই শোনা যায় হৃদয়স্পর্শী করুণ সুর। শোকের প্রতিধ্বনিময় সেই সুরেলা শব্দধ্বনির মাঝে চোখ আটকে যায় একটি ছবির ফ্রেমে। বাদামি রঙের জমিনে সৃষ্ট ক্যানভাসটিতে আনন্দঘন মুহূর্তে সপরিবারে দৃশ্যমান হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখাবয়বে ধরা দিয়েছে স্মিত হাসি। স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের দুই হাতের বেষ্টনীর মাঝে কোলে বসে রয়েছে শেখ রাসেল। জাতির পিতার ডান পাশে রয়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিল্লাতুন নেছা মুজিব।
অনেকটা একইরকম ভঙ্গিমায় সর্বডানে দেখা যায় শেখ জামাল ও শেখ হাসিনাকে। চিত্রপটের বাঁ পাশে ঝলমল করা হাসিতে আবির্ভূত হয়েছেন শেখ রেহানা। তার পাশে রয়েছেন শেখ কামাল। সুখী পরিবারের প্রতিচ্ছবিময় চিত্রকর্মটি এঁকেছেন শাহজাহান আহমেদ বিকাশ। ছবিটি ঠাঁই পেয়েছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার এক নম্বর গ্যালারিতে। বিস্তৃত পরিসরের এই গ্যালারির চারপাশের দেওয়ালে ঝুলছে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষ্যবহ চিত্রকর্ম।
প্রখ্যাত থেকে প্রবীণ কিংবা নবীন থেকে উদীয়মান শিল্পীদের আঁকা সেসব ছবিতে নানা অভিব্যক্তিতে মূর্ত হয়েছেন শেখ মুজিব। চিত্রকর্মের বাইরে প্রদর্শনালয়ের মেঝেতে উঁকি দিচ্ছে ভাস্কর্য। রয়েছে স্থাপনাশিল্প থেকে ভিডিও আর্ট ও আলোকচিত্র। আর এই বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর মাধ্যমে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত শোকাবহ আগস্ট শীর্ষক মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় বৃহস্পতিবার।
ছবি দেখতে দেখতে নজর নিবদ্ধ হয় মেঝেতে রাখা একটি ভাস্কর্যে। বোর্ডের ওপর গড়া শিল্পকর্মটিতে বৃত্তাকারভাবে ছড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তানি সেনারূপী অজ¯্র পেরেক ও গজাল।
বাংলার স্বাধীনতার শৃঙ্খলের প্রতীকী সেই পেরেকগুলোর মাঝ থেকে উঠে এসেছে প্রতিবাদে সোচ্চার একটি তর্জনী। প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবিসংবাদিত নেতার ওই তর্জনীর ইশারায় রয়েছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের আহ্বান। স্বাধীনতার শেষ ঘোষণা শীর্ষক ভাস্কর্যটি গড়েছেন ভাস্কর শহীদুজ্জামান শিল্পী। জামাল আহমেদের চিত্রিত চিত্রপটে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপরত অবস্থায় দেখা যায় মুজিবকে। শত চিত্রকর্মের মাঝে চিত্রণশৈলীর বৈশিষ্ট্যের কারণে শাহাবুদ্দিন আহমেদের আঁকা ক্যানভাসটি বিশেষভাবে নজর কাড়ে।
গতিময় রেখার টানে চিত্রপটে উপরের অংশে মূর্ত হয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। মাঝে তর্জনী উঁচিয়ে স্বাধীনতার বার্তাবহ ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। জমিনের অংশে মূর্ত হয়েছেন সহোদরা। পরস্পরের হাতে হাত রেখে বুকে জড়িয়ে শেখ রেহানার গালে ¯েœহ-মমতার প্রকাশে চুমু দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। হামিদুজ্জামান খানের নিকষ কালো ক্যানভাসের ফাঁকা জায়গায় মূর্ত হয়েছে মুজিবের মুখচ্ছবি। সেই মুচ্ছবির নিচের অংশে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা।
ছবির একটি অংশে ভাসছে বাঙালিত্বের গৌরববোধের প্রকাশে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ নিঃসৃত অবিনশ্বর পঙ্ক্তিমালা- যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, সে জাতি কারও কাছে মাথা নত করতে জানে না ...। কনক চাঁপা চাকমার ক্যানভাসে লাল-সবুজের গভীরে বির্মূত রূপে মূর্ত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আলপ্তগীন তুষারের চিত্রপটে তারুণ্যে মূর্ত হয়েছেন মুজিব। পুড়তে থাকা ঘরবাড়ি, মন্দিরের সিঁড়িতে শায়িত লাশ আর সড়কে খুনোখুনি, মাঝে দাঙ্গা প্রতিরোধে তৎপর ভূমিকায় দেখা যায় মুজিবকে।
এছাড়া হাশেম খান, ফরিদা জামান, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আব্দুস শাকুর শাহ, আবুল বারক্্ আলভী, আব্দুল মান্নানের মতো খ্যাতিমান শিল্পীদের সমান্তরালে আনিসুজ্জামান, সোহাগ পারভেজের মতো প্রতিশ্রুতিশীল চিত্রকরদের চিত্রকর্মগুলো প্রদর্শনীতে যুক্ত করেছে ভিন্ন মাত্রা।
শ্রাবণের বৃষ্টি¯œাত বিকেলে শিল্পায়োজনটির উদ্বোধন করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক চিত্রশিল্পী মিনি করিম। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ, শিল্প সমালোচক মঈনউদ্দিন খালেদ ও চারুশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী।
উদ্বোধন বক্তব্যে লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিল অপপ্রচার। এই অপপ্রচার দেখে কেউ বিশ্বাস করেছে এবং অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বেও এই একই অপপ্রচার এখনো চলছে। কোনো অপশক্তির ক্ষমতা দখলের অন্যতম হাতিয়ার এই অপপ্রচার। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও চলছে এই অপপ্রচার। তাই এই অপপ্রচার ও গুজবের বিরুদ্ধে ১৫ আগস্টে ‘আর্ট এগেইনেস্ট ফেইক নিউজ’ শীর্ষক আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন কবা হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতায় দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে নানা স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি সহিংসতায় নিহতদের বিচারের দাবি জানান।
বিভিন্ন সময়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত আর্ট ক্যাম্পের সংগৃহীত শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রদর্শনী। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৃজিত ২১০টি শিল্পকর্মে সজ্জিত মাসব্যাপী প্রদর্শনী চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।