ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ১ আগস্ট ২০২৪

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

গণআদালতের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের জোর দাবি জানানো হয়েছিল

বাংলাদেশে বহু গালাগাল প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম গালিটি যে ‘রাজাকার’, সে কথা বলাই বাহুল্য। এই রাজাকারদেরই দল জামায়াত-শিবির। প্রচ- ঘৃণার জায়গা থেকেই মানুষ ‘জামায়াত-শিবির’ শব্দ দুটি একসঙ্গে উচ্চারণ করে। ‘জন্তু-জানোয়ার’ বলি না আমরা? অনেকটা সে রকম। প্রগতি বিরোধী উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী দর্শন আর বিভ্রান্তিকর মতবাদের ওপর ভিত্তি করে এই দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। না, আজকের কথা নয়। ব্রিটিশ ভারতে প্রথম গজায় এই বিষফোঁড়াটি।

আবুল আলা মওদুদী নামের চরম বিতর্কিত এক ব্যক্তি ছিলেন নেপথ্যে। দেশভাগের পর তিনি ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন। ধর্মকে নোংরা রাজনীতির হাতিয়ার করেন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি করা দাঙ্গায় লাহোরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বহু মানুষ মারা যায়। রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হওয়ায় পাকিস্তানে দু-দুইবার নিষিদ্ধ করা হয় দলটিকে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯৭২ সালে। আর তার পর বৃহস্পতিবার দ্বিতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করল সরকার। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দল মোট চারবার নিষিদ্ধ হলো।

তবে পাকিস্তানে যেসব কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিল তার চেয়ে কয়েক শ’ গুন অন্যায় অপরাধ ওরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংগঠিত করেছিল। আজ যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, জামায়াত তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুট জিহ্বা দিয়ে চেটে সাফ করে দিয়েছে এরা। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে আধা সামরিক বাহিনী গঠনে করে পাকিদের সহায়তা করেছে।

সরাসরি গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ লুটপাটে জড়িত ছিল। যাঁরা দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করছে তাঁদেরকেও হায়েনার দল ধরে নিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিত! নিজের পাড়া মহল্লার তরুণী এমনকি কিশোরীটিকে তুলে নিয়ে যেত ওরা। তার পর পাকিস্তানি বর্বরদের বাঙ্কারে দিয়ে আসত। ফেসবুক থেকে কিছু সময়ের জন্য  চোখ সরান, প্রিয় প্রজন্ম। চোখ বন্ধ করুন। একবার কল্পনা করুন দৃশটা। অথচ এর পরও জিয়াউর রহমান তাদের দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

এক পর্যায়ে দেখা গেল, পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ঢোকা জামায়াতের শীর্ষ নেতা দেশদ্রোহী খুনি গোলাম আযম নাগরিকত্ব পেয়ে গেল। রাজাকার শিরোমনি দায়িত্ব নিল জামায়াতের। সেই থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল জামায়াত-শিবির। তবে এদের রাজনীতি কোনোদিন মেনে নেয়নি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। ভোটের পরিবর্তে গোষ্ঠীটি শুধু ঘৃণা কুড়িয়েছে। আগাছা হয়ে টিকে থাকলেও, স্বাধীনতার বিরোধিতা ষড়যন্ত্র চালু রেখেছে সব সময়। কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে চালিয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকা-।

জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে তাই সব সময় সতর্ক ছিল নাগরিক সমাজ। তরুণরা বারবার গর্জে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা দেখেছে বিপুল আলোড়ন তোলা গণআদালত। শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে সামনে রেখে দেশের প্রগতিবাদী নাগরিক বুদ্ধিজীবী সমাজ, তারুণ সমাজ এবং সর্বোপরি গণমানুষ একত্রিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে।

তখন থেকে অব্যাহতভাবে কমিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। অনেকে জেনে হয়তো অবাক হবেন যে, আজকের ডানপন্থি শিক্ষক টকশোর পরিচিত মুখ আসিফ নজরুল নির্মূল কমিটির একজন হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের পক্ষে ব্যাপক সরব ছিলেন। আজ তার কী হলো? প্রশ্ন  উঠতেই পারে। 
গণজাগরণ মঞ্চের স্মৃতি ॥ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মনে করিয়ে দিচ্ছে ইতিহাস সৃষ্টি করা গণজারণ মঞ্চের স্মৃতিও। গণআদালতের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে আরও বড় ঢেউ, আরও বড় তুফান হয়ে এসেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী শহর ঢাকার শাহবাগে গড়ে উঠেছিল তরুণদের এই মঞ্চ। গোটা বাংলাদেশে তো বটেই, দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবি তুলেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম।

সেই সব উত্তাল দিনের কথা একবারের জন্যও কি ভোলা যায়!  সরকার আদালত একমত হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চের দাবি পূরণ হয়েছিল। ফাঁসি হয়েছিল বেশ কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর। একই সময় গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবির অন্যতম একটি দাবি ছিল ‘জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’ এই দাবি পূরণ আর হচ্ছিল না। ফলে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে এই দাবি জানিয়ে আসছিলেন এবং অতঃপর এ দাবিটিও পূরণ হলো।

শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে স্বস্তির খবর আর কী হতে পারে! সেদিন গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্ম হওয়া কোটি কোটি মানুষ বাড়ি ফিরে গেছে, তবে, চেতনা থেকে সরে যায়নি। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সেই চেতনার জয় হলো। হামলা, ভাঙচুর ও তা-ব না চালিয়েও অনেক বড় কিছু অর্জন করা যায়, দেখিয়ে দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রয়োজন হলে আবারও মাঠে নামবে গণজাগরণ মঞ্চের শান্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা কর্মীরা। কারণ শাহবাগ জেগে থাকে/ শাহবাগ ঘুমায় না।

×