ছেলে রাদমান ও রুহানের সঙ্গে মা মাসুমা
মা- পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি একটা শব্দ। যে শব্দের সঙ্গে আবেগ, ভালোবাসা, দায়িত্ব, কর্তব্য সব একাকার হয়ে আছে। মায়ের ভালোবাসার বিকল্প হয় না। কিন্তু তারপরও মায়েরাও যেহেতু মানুষ, কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়তো হয়ে যায়, সেটা নিয়েই লিখেছেন হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (মানসিক রোগ বিভাগ)-
ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
আজকাল অনেক সন্তানের, বিশেষত মেয়েদের দেখি মায়ের প্রতি একটা ক্ষোভ বা বিদ্বেষ প্রকাশ করতে। সেটা আমি টিনএজ রোগী থেকে পরিণত বয়সের রোগী পর্যন্ত দেখেছি। প্রথম দিকে কিছুটা অবাক লাগতো এটা ভেবে- মায়ের প্রতি মানুষ কিভাবে ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ পোষণ করে! কিন্তু এখন রোগীদের হিস্ট্রি কিংবা নিজের চারপাশ দেখে বুঝি যে, মায়েদের প্রতিও সন্তানদের ক্ষোভ-বিদ্বেষ কেন হয়! যেসব মায়েদের বাড়ন্ত বয়সী বা টিনএজ মেয়ে আছে, উনাদের কিছু পরামর্শ দিতে চাই আমার রোগী দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে। এদেশের বেশিরভাগ মায়েরা সন্তানদের রান্না করে খাওয়ানো আর অনেকে স্কুলে আনা-নেয়া করা একটা বড় এবং প্রধান কাজ মনে করেন। কিন্তু সন্তানকে সময় দেন ক’জন? মানে সন্তান কোনো সমস্যায় আছে কি না, সে মানসিকভাবে কোনো কষ্টে আছে কি না- এসব জিজ্ঞেস করার মতো মা সম্ভবত খুব কমই আছেন।
বাবারা ভাবেন- ‘আমি’ কষ্ট করে টাকা কামাচ্ছি তোদের ভবিষ্যতের জন্য। তোরা পড়বি, তোদের আর কথা কিসের... শেষ।
মায়েরা ভাবেন- ‘আমি’ দিন রাত কষ্ট করে রান্না-বান্না করি, স্কুলে আনা-নেয়া করি, কত কষ্ট করি, তোরা পড়াশোনা ঠিকমতো করা ছাড়া আর কি করবি?
এই ‘আমি’- আমিত্ব আমাদের সব সমস্যার মূল। আমরা সবসময় আমাদের সমস্যা নিয়ে, আমাদের কষ্টগুলো নিয়ে ব্যস্ত। অপর পাশে বসা মানুষটা, সে নিজের সন্তানই হোক- তার ভাবনা নিয়ে ভাবার সময় আমাদের নেই। মায়েরা সন্তানদের সঙ্গে দিনের একটা সময় একটু বসে কথা বলুন। সন্তান কথা শেখার পর থেকেই তার সাথে কথা বলুন। দেখবেন তাহলে বেশিরভাগ টিনএজ ছেলে-মেয়ে, যাদের মানসিক সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসতে হয়, আসা লাগবে না। শুধু কথা বলুন নিয়মিত, সহযোগী-সহমর্মী হয়ে, সহানুভূতি নিয়ে। তার সমস্যা হলে অভয় দিন, আশ্বস্ত করুন, উপদেশ কিংবা পরামর্শ দিন।
আমাদের কাছে সন্তানদের যেসব সমস্যা নিয়ে বাবা-মায়েরা আসেন, তার মধ্যে প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে কনভার্শন ডিজঅর্ডার, এংজাইটি, ডিপ্রেশন, ওসিডি, অবাধ্য বাচ্চা, অতিরিক্ত রাগ, নিজেকে আঘাত করা... এবং এসবের পেছনে একটা বড় কারণ থাকে বাচ্চাদের সঙ্গে তার বাবা-মায়ের মানসিক কানেকশন না থাকা। ফলে আপনার সন্তানটি কোনো স্ট্রেসে বা মানসিক চাপে ভুগলে, বুলিং এর শিকার হলে বা অন্য কোনো সমস্যায় ভুগলে আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। কারণ সেরকম পরিস্থিতি নেই আপনার বাসায়। সে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেতে পেতে কখনো আউট বার্স্ট করে, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, কখনো সে নিজেকেই শেষ করে দেয়।
আমি মা- আমি সব করব, সন্তানকে দুধে-ভাতে মাথায় তুলে রাখব- এটাই যেন হচ্ছে বেশিরভাগ মায়ের মটো! এটা কি ঠিক?
মায়েরা সন্তানদের ঘরের স্বাভাবিক কাজকর্ম শেখান, নিজের কাজ নিজে করা শেখান ছোটবেলা থেকেই। ১৫-১৬ বছর হতেই ব্যসিক রান্না-বান্না শিখিয়ে ফেলুন ছেলে-মেয়ে উভয়কেই। এতে আপনার সন্তান সাবলম্বী হবে। অন্য কারও বোঝা হবে না, কাজ করতে হবে এই ভয় পেয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হবে না। সেই সন্তান আপনাকে মানে মা’কে কাজে সাহায্য করাকে দায়িত্ব মনে করবে, ভবিষ্যতে সেই একজন আদর্শ স্ত্রী বা আদর্শ স্বামী হবে।
সন্তানকে মানুষ বানান, রাজকন্যা বা রাজপুত্র নয়। তাকে সুশিক্ষিত বানান। আর সন্তান সুশিক্ষিত হয় মূলত মায়ের কাছ থেকে শিখেই। অবশ্যই আপনার অজান্তেই আপনার ভালো-মন্দ আচরণ, ব্যবহার,ব্যক্তিত্ব সে কপি করে নিচ্ছে।
আসলে জন্ম দেওয়া কঠিন, কিন্তু আদর্শ মা হয়ে ওঠা ‘ভীষণই কঠিন’। এই ‘ভীষণ কঠিন’ ব্যাপারটির জন্যই হয়তো মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত বলা হয়।
সন্তান প্রতিপালনে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার ভূমিকাও প্রায় একই। ঘরের কাজকর্ম কিংবা ব্যসিক আচরণ বাচ্চারা প্রধানত মাকে দেখেই শিখে। কারণ মা’কেই কাছে পায় বেশি। এজন্যই সন্তান লালন-পালনে মায়ের ভূমিকাও একটু বেশি।