ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নাম না জানা অসংখ্য শহীদের বধ্যভূমি ‘বেজোড়া’

সারি বেঁধে হানাদাররা প্রতি রাতে হত্যা করত মুক্তিকামীদের

মাহমুদুল আলম নয়ন

প্রকাশিত: ০০:১০, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

সারি বেঁধে হানাদাররা প্রতি রাতে হত্যা করত মুক্তিকামীদের

অযত্ন অবহেলায় থাকা বগুড়া চকলোকমান বেজোড়া বধ্যভূমি

রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে হানাদারদের রাইফেল যখন আর্তনাদ ছড়িয়ে দিচ্ছিল তখন শুধুই নির্মম নিষ্ঠুরতায় চলছিল হত্যাযজ্ঞ। প্রকৃতির নির্মলতাকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী উন্মত্ত হিংস্রতায় রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল উল্লাসে। বুলেট বুক বিদীর্ণ করার আগে কারও চোখে কোন প্রিয়মুখ ভেসে উঠেছিল হয়তো। তবে মানুষরূপী পাকিদের তা একটুও টলাতে পারেনি। কারণ বাঙালি নিধনই যে ছিল তাদের নেশা। সে যে কেউ হোক। তাদের বর্বরতায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল একের পর এক মুক্তিকামী মানুষ। সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার পাকিদের নিকট ছিল এক সাধারণ বিষয়।

পাক হানাদারদের হাতে অনেক শহীদের বধ্যভূমির একটি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বোজোরা বধ্যভূমি। চকলোকমান সীমানায় নদীর ধারে এই বধ্যভূমিটি এখন আড়ালেই পড়ে থাকছে অযতœ অবহেলায়। সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে প্রায় অর্ধশত নাম না জানা মুক্তিকামীকে হত্যা করা হয়েছিল এই বধ্যভূমিতে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও শহীদদের এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের অবহেলায় আড়াল পড়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের নিকট অনেকটাই অচেনা এই বধ্যভূমির কথা। প্রতি রাতে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে মুক্তিকামী মানুষদের বুক ঝাঁজড়া করে দিতো পাকি ঘাতকদের বুলেট। শব্দহীন আঁধারে বোবা প্রকৃতি আর মাটির পরম মমতা ছিল তাদের সঙ্গী।
বগুড়ার মুক্তিসংগ্রামের কথা উঠলেই শহীদ চান্দু, মাসুদ, মাসুদ, আজাদ, তোতা, চুন্নু, খোকনসহ একসঙ্গে অনেক শহীদের নাম ভেসে ওঠে। প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। হানাদার বাহিনীর সম্মুুখযুদ্ধে দেশমাতৃকার জন্য যারা বুলেটের সামনে মুক্তিসেনানীরা বুক উঁচিয়ে ধরতে দ্বিধা করেননি। এসব শহীদের বগুড়া জেলাজুড়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক বধ্যভূমি। এখনো অনেক বধ্যভূমি লোকচক্ষুর আড়ালে অযতেœ রয়ে গেছে। বিজয় বা স্বাধীনতার মাসে এসব বধ্যভূমির কথা স্মরণ হলেও অন্য সময় অজান্তেই থেকে যায় মুক্তি সংগ্রামে প্রাণ দেওয়া নাম না জানা অনেক শহীদদের বধ্যভূমির কথা। এমনি এক বধ্যভূমি বগুড়ার বোজাড়া ঘাট সংলগ্ন বধ্যভূমি।

শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া এক সময় স্রোতস্বিনী নদী ছিল। চলতো গয়না নৌকাসহ বড় ধরনের অনেক নৌকা। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বে চকলোকমান এলাকা। এর পাশের করতোয়া নদী। আগে ছিল ঘাট। এখন বোজোরা ব্রিজ। নদীর স্বচ্ছ স্রোত উচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়ত নদীর দুই তীরে। পাশের জমি ছিলো আনেকটা নিচু ও দহ। এই ঘাটের পাশেই চকলোকমান এলাকায় নাম না জানা অনেক শহীদের এক বধ্যভূমি। কতজন শহীদ এখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন তার সঠিক হিসাব এখনো নেই।

শাজাহানপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গৌর গোপাল গোস্বামী যুদ্ধদিনের অনেক স্মৃতির কথা তুলে তাদের কমান্ডার শহীদ মাছুদুল ইসলাম খান চান্দুর শহীদ হওয়ার ঘটনাসহ বগুড়ার সারিয়াকান্দি গাবতলি ও ধুনটে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধের কথা বলে জানান, বগুড়ার বেজোড়ায় শহীদদের মধ্যে নাম তারা জানতে অনেক চেষ্টা করলেও শুধু দানেশ উদ্দিন নামে এক শহীদের কথা জানতেন।
বেজোড়া ঘাটের নিকট এই বধ্যভূমির কথা তরুণ প্রজন্মের অনেকের নিকটই আড়াল হয়েছে। তরুণ তানভীর জানালেন, তার বাড়ি চকলোকমান হলেও এখন থাকেন অন্য এলাকায়। তাই তার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই। আরেক তরুণ জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েক জনকে এখানে হত্যা করা হয়েছিল। এ রকমই ভাসা ভাসা ধারণা তরুণদের। নদীর পাড়েই বধ্যভূমি। ব্যক্তি উদ্যোগে কবরস্থানের মতো ঘিরে দেওয়া। এখন চারদিকে আগাছা। ঘিরে দেওয়া প্রাচীরে পলেস্তারা উঠে গেছে। এক সময় ব্যক্তি উদ্যোগে নামফলক দেওয়া হয়েছিল।

রাস্তার পাশে নদীর ধারে এই বধ্যভূমি হলেও মূল রাস্তার ওপর থেকে তা দেখা যায়না। সেখানে যাওয়ার কোন সরাসরি রাস্তাও নেই। বাঁশের একটি সাঁকো পার হয়ে সরু মোঠো পথ দিয়ে অনেক কষ্টে সেখানে পৌঁছানো যায়। বধ্যভূমির পূর্ব পাশের বাসিন্দা ব্যবসায়ী শাজাহান জানান, তখন তিনি ছিলেন শিশু। তার বাড়ি থেকে তাকালেই বধ্যভূমি। এর অন্য পাশে চকলোমান ঈদগাহ মাঠে ছিলে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। প্রতিরাতেই তারা বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ধরে এনে এখানে হত্যা করে মাটিচাপা দিত। বোজোড়া ঘাটপাড়ের তোফাজ্জল হোসেন জানালেন, ঠিক কোন মাসে এখানে হত্যা করা হয়েছিল  সেটি তার মনে নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় ৩ মাস পর ক্যাম্প গেড়েছিল পাক হানাদার বাহিনী।

একদিন ভোরে গরু চড়ানোর জন্য নদী পেরিয়ে বধ্যভূমির মাঠে আসলেই সেখানে ২২টি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পাক বাহিনী সেগুলো দহে (নিচু এলাকা) মাটি চাপা দিয়েছিল। তিনি আরও জানান, দানেশ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির কাপড় জুতা পরিচয়পত্র দেখে পরিবারের সদস্যরা অনেক পড়ে জেনেছিল তাকে এখানে হত্যা করা হয়। দানেশ উদ্দিন ছিলেন বগুড়া কটন স্পিনিং মিলের ক্যাশিয়ার। পরে তার পরিবারই সেখানে ২ শতক জমি কিনে একটি কবরস্থানের মতো ঘিরে একটি কাঠামো তৈরি করেছিলেন। সেটির এখন ভগ্নদশা। চারদিকে শুধু আগাছা। শুধু বুক উঁচিয়ে রয়েছে একটি কদম গাছ। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাক বাহিনী মুক্তিকামীদের ধরে এনে হত্যা করত।

চকলোকমান নামাপাড়ার শহিদুল ও বেজোড়া ঘাট এলাকার শাজাহান জানালেন, প্রায় ৫৬ জনকে এখানে হত্যা করা হয়েছিল। তবে অনেকে এর সংখ্যা আরও বেশি বলে জানান। নাম না জানা অনেক শহীদের এই বধ্যভূমি নদীর ধারে একটি মাঠে। এটি পড়ে চকলোকমান এলাকায়। তবে নদীর ঘাটে। সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।
একটি বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে গেলেই চোখে পড়বে বধ্যভূমি। রাস্তা থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই সেখানে নাম না জানা অনেক শহীদ চিরনিদ্রায় রয়েছেন বধ্যভূমিতে। এলাকাবাসী জানালেন, আগে বিজয়ের মাস এলে অনেকে ফুল নিয়ে আসতেন। এখন কেউ আসেনা। খোলা মাঠে নদীর ধারে রোদ্দুর ও বৃষ্টিতে বধ্যভূমি পড়ে থাকে একাকী। হয়তো এক বুকচাপা কান্না নিয়ে। এলাকার বাসিন্দা এক সময়ের বিমান বাহিনীর সৈনিক আব্দুল আজিজ জানান, তার স্ত্রীর বড়ভাই শিক্ষক জিল্লুর রহমানকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে এনে সেখানে হত্যা করেছিল।

তিনি ওই এলাকায় বসবাস শুরু করেন অবসর নেওয়ার পর। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। তিনিসহ এলাকার সব শ্রেণির মানুষের দাবি বধ্যভূমি সংস্কার করে সেখানে যাওয়া আসার রাস্তা করা হোক। গড়ে তোলা  হোক একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এর মাধ্যমেই নতুন প্রজন্মের কাছে পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও মুক্তিযুদ্বের কথা উঠে আসবে। শহীদদের ত্যাগের কথা জাগরুক থাকবে নতুন প্রজন্মের নিকট।

×