
.
প্রতিটি ফুটপাতের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে বসানো ছোট ছোট চৌকি। মূল দোকান ঘেঁষে একটি চৌকি, মাখঝানে একটু ফাঁকা রেখে ফুটপাতের অন্যপ্রান্তে আরেকটি চৌকি। অর্থাৎ একটি ফুটপাতের আয়তন যদি ৮ ফুট হয়, এর মধ্যে ৬ ফুটই হকারদের বসানো চৌকির দখলে। আর দুই চৌকির মাঝখানে যে দুই/আড়াই ফুট ফাঁকা রাখা হয়, সেখান দিয়ে পথচারীদের হাঁটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেননা, ওই জায়গাও থাকে হকারদের কাছে পণ্য ক্রয় করতে আসা ক্রেতাদের দখলে। এটুকু ফাঁকা পথ দিয়ে হেঁটে যেতে পথচারীদের এক প্রকারে যুদ্ধ করতে হয়। বলা যায়, ফুটপাতের পুরোটাই হকারদের দখলে।
ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে না পেরে সাধারণ পথচারীরা নেমে আসেন মূল সড়কে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। মূল সড়কের ফুটপাত ঘেঁষা ভাসমান হকারদের দোকান। এক লেনের একটি রাস্তার অর্ধেকই হকারদের আখের রস মাড়াইয়ের মেশিন, শরবতের দোকান, ওজন পরিমাপের মেশিনসহ ছোট ছোট পসরার দখলে। ফলে সেখান দিয়েও সাধারণ পথচারীদের হাঁটতে বাধা। তাহলে পথচারীরা হাঁটছেন কোথায় দিয়ে? এই প্রশ্ন জাগতেই পারে। পথচারীরা এই ফুটপাত আর সড়ক দিয়েই হাঁটছেন। তবে এক প্রকারে যুদ্ধ করে। ধাক্কাধাক্কি, ঝক্কি-ঝামেলা আর পথে পথে অন্যের সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে করতে। আবার ফুটপাত আর মূল সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটতে না পেরে পথচারীরা দ্রুতগতির যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকেও হাঁটছেন। এতে ডানে-বামে, সামনে-পেছনে সমানতালে খেয়াল রেখে চলতে হচ্ছে। মনোযোগে একটু বিচ্যুতি ঘটলেই গায়ের ওপর উঠে যাচ্ছে যানবাহন এবং উঠছেও। ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ
ঢাকার পুরো ফুটপাতের এই বেহালদশা। মূল সড়কের পাশে জনসাধারণের হেঁটে চলার জন্য তৈরি করা ফুটপাতের কোথাও মাঝখানে হলুদ টাইলস বসানো হয়েছে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য। টাইলস বদলানো এবং সৌন্দর্য বর্ধনের নামে কোটি টাকা খরচ করছে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রশ্ন উঠেছে- কোটি টাকার টাইলস বসানো এই ফুটপাত যাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে অর্থাৎ জনসাধারণ ও প্রতিবন্ধীরা কতটুকু ব্যবহার করতে পারছেন? তা খতিয়ে দেখতে বেশ কয়েকদিন গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, সদরঘাট, পুরান ঢাকার আদালত পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, মালিবাগ, বাড্ডা, মিরপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এসব এলাকার সব ক’টি ফুটপাথ হকারদের দখলে। এসব এলাকার যেসব সড়ক দিয়ে সাধারণ মানুষ বেশি চলাচল করেন, সেসব এলাকার ফুটপাত আরও বেশি হকারদের দখলে। হকার ছাড়াও ফুটপাতজুড়ে ব্রিজের খাম্বা, পুলিশ বক্স, বিদ্যুৎ-টেলিফোনের খুঁটি, নির্মাণ সামগ্রী, সুইচ বক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠতে দেখা গেছে। তবে হকাররা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ফুটপাতে বসলেও এর জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়।
ঠেলাগাড়ির ওপরে পোশাক ও রোদচশমার ভ্রাম্যমাণ দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে পথচারী অভি শেখ বললেন, ১০ বছর ধরে এই রাস্তা দিয়ে (গুলিস্তান হয়ে মতিঝিল) হেঁটে অফিসে যান। দিন দিন হাঁটার জায়গা কমছে। প্রশাসন এটা জেনেও চুপ করে আছে, অভিযোগ করেন তিনি।
গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় ৪৫টির মতো ফুটপাতে ভাসমান হকার বসেন। এসব ফুটপাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তালিকাভুক্ত হকার আছেন ২ হাজার ৫০২ জন। বাস্তবে এই সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার হবে।
ফুলবাড়িয়া থেকে বংশাল পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে হকারদের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও সদরঘাটগামী মানুষের ওখান দিয়ে হাঁটা বড়ই দায়। কেননা, রাস্তার দুই পাশে পাইপ, স্যানিটারি, টিউবওয়েল, বয়লার, সিরামিকের ৫ হাজার দোকান থেকে পণ্য ক্রয় করতে আসা ক্রেতা ফুটপাত ও মূল সড়ক দখল করে ভ্যান, কাভার্ডভ্যানে মালামাল বোঝাই করছেন। ট্রাফিক পুলিশ রাত ৯টার পর থেকে ট্রাকসহ অন্যান্য গাড়ি লোড, আনলোড করার সময়সীমা বেঁধে দিলেও তা মানছে না ব্যবসায়ীরা। তবে এসব প্রশাসনের চোখের সামনেই ঘটছে।
পুরান ঢাকার আদালত পাড়াসহ সদরঘাটের প্রত্যেকটি সড়ক এমনভাবে হকারদের দখলে, এতে ওইসব সড়ক ধরে হেঁটে যাওয়া দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে একপ্রকারে যুদ্ধ করেই লঞ্চ ঘাটে যেতে হয়। হরেক রকমের ফলের পসরা, কলা-রুটি, পানির বোতল নিয়ে বসে থাকেন হকাররা। ফলে ঈদ উপলক্ষে গ্রামমুখী মানুষের নাজেহালের অন্ত থাকে না। তবুও যুগ যুগ এভাবেই চলছে।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে নিউমার্কেট-নীলক্ষেত জুড়ে। কিন্তু জনবহুল এই এলাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটা মুশকিল। এখানকার ফুটপাত দখলের পর মূল সড়কেও ছোট ছোট পসরা সাজিয়ে বসছেন হকাররা। রিক্সা, ভ্যান, লেগুনা স্ট্যান্ডের ফলে সড়ক দিয়েও হাঁটতে পারছেন না পথচারীরা। এই এলাকায় ডিএসসিসি’র তালিকাভুক্ত হকার রয়েছেন ৭ হাজার ৬০০ জন। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
ধানম-ির ঝিগাতলা থেকে মোহাম্মদপুরের মেইন রোডের দুই পাশের ফুটপাতে কয়েক শত অবৈধ দোকান। ধানমন্ডির ৬/এ সুগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারের সামনের রাস্তায় প্রতিদিন ভোর বেলা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত শাকসবজি, মাছ, মুরগি, ডিম, নারিকেলসহ হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসেন প্রায় ৪০ জন হকার। ওই সড়কের ফুটপাতে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে স্থানীয়ভাবে বসানো হয়েছে ৪টি ভাতের দোকান। পাশেই করা হয় রান্না। ফুটপাতটির উত্তরপ্রান্তে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ বক্স। স্থায়ীভাবে ভাতের দোকান, পুলিশ বক্সসহ অন্যান্য স্থাপনা থাকার কারণে ওই ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া পথচারীরা পথিমধ্যে বাধা পান, ফলে ফুটপাত থেকে নেমে মূল সড়ক ধরে হাঁটতে হচ্ছে তাদের।
আবাহনী মাঠের চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে প্রায় ২০টি নার্সারির দোকান। ওই মাঠে সকালে ব্যায়াম করতে আসা ও খেলতে আসা স্থানীয়দের প্রতিনিয়িত বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। অথচ মাঠটির পূর্ব প্রান্তেই রয়েছে পশ্চিম ধানমন্ডি আদর্শ পুলিশ ফাঁড়ি। ওখানকার হকারদের এতটাই ক্ষমতা, তাদের উচ্ছেদ করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরিনা নাজনীন জনকণ্ঠকে বলেন, ধানমন্ডি এলাকার হকারদের বিরুদ্ধে তিনি অন্তত ৩০ বার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছেন। কিন্তু তারপরও ওখানকার ফুটপাত হকারমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ঘণ্টা খানেক পর ফের বসে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই কাজে আসছে না।
ফার্মগেটে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, চাকরির একাধিক কোচিং সেন্টার, রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। তাই শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের চলাচলও বেশি এই এলাকায়। কিন্তু ফার্মগেট ক্যাপিটাল মার্কেট, সীজান পয়েন্ট, ফার্মভিউ মার্কেটের সামনের ফুটপাত দিয়ে হাঁটা দায়। পূর্ব তেজতুরী বাজার, গ্রীন রোড, ইন্ধিরা রোডসহ পুরো ফার্মগেটের ফুটপাত দখল করে বসে আছেন হকাররা। তাই অন্য এলাকার মতো এখানকার ফুটপাত ধরেও স্বস্তিতে হাঁটতে পারছেন না পথচারীরা। আগেও ওখানে ফুটওভার ব্রিজ থাকায় সাধারণ মানুষ সহজে ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পেরুতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে ব্রিজ না থাকায় ওখানকার ফুটপাত ও সড়কে গাড়ির চেয়ে মানুষের জটলাই বেশি।
এছাড়া মোহাম্মদপুর, মালিবাগ, বৃহত্তর মিরপুর, বাড্ডাসহ রাজধানীর প্রত্যেক সড়কের একই অবস্থা। এসব এলাকার ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় পথচারীরা নির্বিঘেœ হাঁটতে পারছেন না। সোজাসুজি হাঁটতে চাইলে পথে হকার, ডানে-বায়ে হাঁটতে গেলে মানুষের জটলা। উপায়ন্তু না পেয়ে মানুষের জটলা আর মূল সড়কে নেমে যান মানুষ, হাঁটেন চলন্ত গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে। এতে মানুষের হাঁটার গতি দিনদিন কমছে।
হকারমুক্ত ফুটপাতের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মনিবুর রহমান বলেন, প্রায়ই সিটি করপোরেশনসহ আমরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে থাকি। কিন্তু উচ্ছেদের কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতে হকাররা ফের বসে পড়ে। আর উচ্ছেদের বিষয়টা মূলত সিটি করপোরেশনের।
দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় তিন লাখেরও বেশি হকার রয়েছে। তবে ফুটপাত দখলমুক্ত করাসহ যানবাহন ও নাগরিকদের চলাচলের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সড়কগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ইতোমধ্যে কয়েকটি সড়ককে লাল, হলুদ ও সবুজ শ্রেণিতে চিহ্নিত করাও হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক লাল রং দ্বারা চিহ্নিত করা হচ্ছে। ‘লাল’ চিহ্নিত সড়কে কোনো ধরনের হকার বসতে দেওয়া হবে না। এ লক্ষ্যে ‘লাল’ চিহ্নিত কয়েকটি সড়কে কয়েক দফা অভিযানও চালিয়েছে ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ডিএসসিসি’র এই উদ্যোগ চলমান রয়েছে। আর কিছু সড়ক গুরুত্ব অনুযায়ী হলুদ ও সবুজ চিহ্নিত করা হবে। সবুজ চিহ্নিত সড়কে সবসময় হকার বসতে পারবে। হলুদ চিহ্নিত সড়কে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত স্থান ঠিক করে দেবে যেখানে হকাররা নির্ধারিত সময়ে বসবে।
মানুষ ফুটপাত ছেড়ে মূল সড়কে হাঁটার কারণে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, এতে গাড়ির গতিও কমে আসছে। গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে পিক আওয়ারে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। চলতি বছরে এই গতি নেমে এসেছে ৪.৮ কিলোমিটারে। উল্টোদিকে বর্তমানে শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের হাঁটার গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় এর চেয়েও বেশি। আরেক গবেষণায় বলছে, ২০-২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৯ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিলোমিটার। ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৪.৮২ কিলোমিটার আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪.৫ কিলোমিটার। এসব বয়সী মানুষের গড় হাঁটার গতি দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৪.৮৩ কিলোমিটার, যেটি বর্তমানে পিক আওয়ারে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি। এআরআই হিসাবে, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ।
বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ আবুল কাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, হকাররা ফুটপাত দখল করে রাখায় পথচারীদের হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। তবে হকারদের উচ্ছেদ করতে হলে আগে তাদের পুনর্বাসনের স্থান নির্ধারণ করে দিতে হবে। এরপর আইডি কার্ডের মাধ্যমে প্রকৃত হকারদের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ফুটপাতকে হাঁটার উপযোগী করতে হলে প্রথমত, হকারদের পরিসংখ্যান করে সিটি করপোরেশন কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের লাইন্সেস দিতে হবে। লাইন্সেসের জন্য তাদের কাছ থেকে নামকাওয়াস্তে একটা ফি নিলেও এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। দ্বিতীয়ত, এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থা করা। একটা নির্দিষ্ট/উন্মুক্ত জায়গায় হকাররা বসবে, সবাই কম খরচে কেনাকাটা করতে সেখানে আসবেন। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ থাকতে হবে।