ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহাসিক দিনে গণজাগরণের সেই উত্তাল স্মৃতি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ঐতিহাসিক দিনে গণজাগরণের সেই উত্তাল স্মৃতি

বইমেলায় আসা ৫টি নির্বাচিত বইয়ের প্রচ্ছদ। বই দেখছেন পাঠক (ডানে)

মনে হয় এই তো সেদিন! গর্জে উঠলো শাহবাগ। নতুন এক ইতিহাস রচনা করল গণজাগরণ মঞ্চ। গোটা দেশের মানুষ এই এক প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন। দাবি তুললেন, যুদ্ধাপরাধের শাস্তি হবে একমাত্র মৃত্যুদন্ড। তার আগে ওই দিনই কুখ্যাত রাজাকার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় দিলেন যাবজ্জীন কারাবাসের। এ দেশের হয়েও যে কসাই কাদের ১৯৭১ সালে বাঙালিদের নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, হত্যায় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছে, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ লুটপাটসহ ভয়াবহ সব অপরাধ সংঘটিত করেছে, সেই নরকের কীট যাবজ্জীন সাজার নামে বেঁচে যাবে! মানতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। প্রতিবাদে সেদিন ফেটে পড়েছিল তারা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক হয়ে বিপুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা দুনিয়া বিস্ময় চোখে দেখেছে শাহবাগ আন্দোলন। এবং একই সময় বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছিল অমর একুশে বইমেলা।

একুশের চেতনা, বইমেলার চাওয়া এবং গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এক দশক আগের সেই স্মৃতি রবিবার যেন ফিরে এসেছিল মেলায়। আয়োজনের পঞ্চম দিনে  বেলা ৩টায় খুলে দেয়া হয় মেলার দ্বার। তখন থেকেই আসতে থাকেন বইপ্রেমীরা। দেখতে দেখতেই শুরু হয়ে যায় বইয়ের খোঁজ। সেইসঙ্গে  গল্প আড্ডা। বহু গল্পে আড্ডায় এদিন ঘুরে ফিরেই আসে শাহবাগের উত্তাল দিনের কথা।
সন্ধ্যায় স্বাধীনতা স্তম্ভের জলাধারের এক পাশে বসে গল্প করছিলেন আন্দোলনে থাকা তরুণদের একটি দল। তাদের একজন ছাত্রনেতা মাসুম। তিনি
জানান, গণজাগরণ মঞ্চের এক দশক উপলক্ষে শাহবাগে কিছু কর্মসূচি ছিল। শেষ করে মেলায় এসেছেন। ২০১৩ সালেও শাহবাগ হয়ে মেলায় আসতেন প্রতিদিন। মেলা থেকে ফিরে যেতেন শাহবাগে। কাছাকাছি দূরত্বে হওয়ায় দুটি অবস্থানই  অনেক সময় এক হয়ে যেত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে বইমেলার সম্পর্ক তুলে ধরে প্রকাশক রবিন আহসান বলছিলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবি তুলেছিল বাঙালি তরুণরা। সেই দাবি আদায়ের মধ্য দিয়েই ভিত রচিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ভাষা আন্দোলন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের দৃঢ় চেতনা থেকে জন্ম নেয় শাহবাগ। ফলে বইমেলার সঙ্গে শাহবাগ খুব সহজেই জুড়ে গিয়েছিল। সে সময় প্রতিদিন শাহবাগ থেকে স্লোগান দিতে মানুষ এসে বইমেলায় প্রবেশ করতেন। আবার বইমেলা শেষ করে কিছু সময় শাহবাগে কাটিয়ে বাসায় ফিরতেন। সেইসব স্মৃতি খুব মনে পড়ছে বলে জানান তিনি।
স্মৃতি রোমন্থন করে আরেক প্রগতিশীল প্রকাশক ওসমান গনি বলেন, আমরা শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম। ইতিহাসটি তুলে ধরে আমিসহ অনেকেই বই প্রকাশ করেছেন। শাহবাগ আন্দোলনের ওপর লেখা বই পাওয়া যাচ্ছে এবারের মেলাতেও। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইতো সব সময় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছি আমরা। আগামী প্রজন্মকে এসব বই পড়তে হবে। বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে জেগে উঠারও আহ্বান জানান তিনি।   
৭৩ নতুন বই ॥ মেলার পঞ্চম দিনে একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে  নতুন বই জমা পড়েছে ৭৩টি।
নির্বাচিত বই ॥ বইমেলা বলে কথা, প্রতিদিনই এখানে আসছে নতুন নতুন বই। অজস্র বই থেকে সংগ্রহে রাখার মতো বই খুঁজে বের করা সহজ কথা নয়। তবে একটু অনুসন্ধিৎসু হলে কিছু বইকে আলাদা করা যায়। তেমন কিছু নির্বাচিত বইয়ের কথা এখন বলা যাক।
আদর্শ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ॥ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বই। বইয়ের নামটি অবশ্য আরও লম্বা। ‘আদর্শ, রাষ্ট্র, রাজনীতি; মুসলিম লীগের অবসান ও আওয়ামী লীগের উত্থান (১৯৪৭-১৯৫৪)।’ হ্যাঁ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যে রাজনীতি, সেটিকে নতুন অনেক তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মুসলিম লীগের কর্তৃত্বের অবসান। অন্যদিকে ও আওয়ামী লীগের উত্থান। লেখক এ সময় কালের রাজনীতির নেরেটিভ তো দিয়েছেনই, সঙ্গে উত্থাপন করেছেন কিছু প্রশ্নও। যে মুসলিম লীগের  নেতৃত্বে একটি দেশের সৃষ্টি হলো সে মুসলিম লীগ মাত্র দশ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল কেন?  আবার আওয়ামী লীগ কয়েকবার বিলুপ্ত হওয়ার পর আবার পুনরুজ্জীবিত হলো কিভাবে? ‘মুসলিম লীগের বড় অবদান পাকিস্তান বা পাকিস্তানায়ন প্রত্যয় সৃষ্টি। মুসলিম গেল, পাকিস্তান গেল, বাংলাদেশ হলো ৫০ বছর। তারপরও পাকিস্তানায়ন প্রত্যয়টি বাঙালির মনে রয়ে গেল কিভাবে?’ এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে বইটিতে। প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স।
১৯৭১ : কীর্তনখোলায় নৌযুদ্ধ ॥ আতহার উদ্দিন তালুকদারের বই। স্মৃতিকথা বটে, সেইসঙ্গে একটি রণাঙ্গনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন তিনি। কীর্তনখোলায় সংগঠিত নৌযুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় বইতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ৫০০ সদস্যের নৌ কমান্ডো বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। নৌ কমান্ডো মানেই ছিল, সুইসাইডাল স্কোয়াড। এই বাহিনীর অভিযান ও তৎপরতা পাকবাহিনীকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। সেইসঙ্গে ত্বরান্বিত করেছিল বাঙালির বিজয়কে। এ দলটিকে  কোনো সেক্টরের আওতায় স্থাপন করা হয়নি তখন। এর কমান্ডার ছিলেন স্বয়ং জেনারেল ওসমানী। গোটা দেশজুড়ে বাহিনীর কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। সুইসাইডাল স্কোয়াড সদস্যদের বুকে বাধা থাকত মাইন বা বিস্ফোরক। শরীরের কোনো জায়গায় লুকানো থাকত ধারালো একটি চাকু। শত্রুর হাতে ধরা পড়লে নিজের বুকে চাকু বসিয়ে  আত্মহত্যার পথ  বেছে নিতে হতো। ১৯৭১ সালে ৪৫ জনের একটি নৌ কমান্ডো বাহিনীকে বরিশাল ও মাদারীপুর এলাকায় নৌ অভিযানে পাঠানো হয়েছিল। লেখক এই সুইসাইডাল স্কোয়াডের একজন কমান্ডো ছিলেন। বইয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ও অভিযানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যা পূর্বপুরুষের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস অবদান সম্পর্কে আজকের প্রজন্মকে জানতে সহায়তা করবে। ‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশিত বইয়ের মূল্য ৪২০টাকা।
মুক্তিযুদ্ধে আঞ্চলিক বাহিনী সমূহ ॥ মো. এনামুল হকের বই। বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিরক্তপূর্ণ ভূমিকা রাখা আঞ্চলিক বাহিনীগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ছোট করেই লেখা। তবে জানা নবীর পাঠকদের এ বিষয়ে কৌতূহলী করবে। লেখকের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে জানা যাচ্ছে, তিনি অনেক বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করছেন। এটি সেই ধারার আরেকটি প্রয়াস।
অপ্রতিম বঙ্গবন্ধু ॥ শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে লেখা বই ‘অপ্রতিম বঙ্গবন্ধু।’ লেখক গাজী মো. মোজাম্মেল হক। বাঙালির মহান নেতা ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময়ের বিচার বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন তুলে ধরেছেন তিনি। বইয়ের প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স।
যখন একাত্তর ॥ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পের বই। সুজন বড়ুয়ার লেখা গল্পে উঠে এসেছে একাত্তরের নানা দিক। বইটি প্রকাশ করেছে আগামী।
লেখক বলছি ॥ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কুদরত-ই-হুদা, বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, আবু সাঈদ তুলু, ফরিদুর রহমান।
আলোচনা অনুষ্ঠান ॥ বিকেলে বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল ‘স্মরণ : সমরজিৎ রায় চৌধুরী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে সভাপতিত্ব করেন শিল্পী হাশেম খান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহিদ মুস্তাফা। আলোচনা করেন শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ, মুস্তাফা জামান এবং আনিসুজ্জামান সোহেল।
এসময় প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী হাতে লেখা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম নক্সাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান লোগোসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের লোগোর প্রণেতা। তিনি ছবি আঁকতেন আমাদের দেশের রূপবৈচিত্র্যকে বিষয়বস্তু করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও ছবি এঁকেছেন তিনি। এছাড়া নিসর্গ ও মানুষ ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়।
সাংস্কৃতিক আয়োজন ॥ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, আসলাম সানী এবং মারুফ রায়হান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মীর বরকত, ইকবাল খোরশেদ এবং কাজী বুশরা আহমেদ তিথি। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াকুব আলী খান, সালাউদ্দিন আহমদ, সুজিত মোস্তফা, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী এবং প্রিয়াংকা গোপ।

×