ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার বিস্মৃত সেই পুঁথিকারের কথা

কবিতা করিল মুন্সি গরীবুল্লা নাম...

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩

কবিতা করিল মুন্সি গরীবুল্লা নাম...

মুন্সি গরীবুল্লা রচিত একটি পুঁথি

ঢাকার পুঁথিকারদের মধ্যে খুব নাম করেছিলেন মুন্সি গরীবুল্লা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কথা, সে সময় পুঁথি রচনা করে আলাদা পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। 
পুঁথির ভনিতায় রচয়িতার নাম পরিচয় তুলে ধরার রীতি প্রচলিত ছিল। মুন্সি গরীবুল্লার পুঁথি থেকেও তার নাম পরিচয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তার একটি পুঁথির শিরোনাম ‘দেল আরাম।’ ১৮৬৭ সালে কলকাতা থেকে মুদ্রিত ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত। এর প্রচ্ছদে বলা হচ্ছে: ‘এই পুস্তকের নাম দেল আরাম। মোছলমান সবের পায়ে আমার সালাম। কবিতা করিল মুন্সি গরীবুল্লা নাম।

ঢাকার সহর বিচে রহমতগঞ্জ মোকাম। যেজন রসিক হবে এই পুস্তকের। পড়িয়া পাইবে মজা আও ওয়াল আখের। মুন্সি নেয়ামতল্লা ছাহেব ওস্তাদ তাহার। সাহাবউদ্দিন বেপারির পুত্র দাদা কামাল উদ্দিন সরকার। ঢাকার জেলায় সাং বহুর বাগ ঘর তায়ের দ্বারায় পুস্তক হইল তৈয়ার।’           
ভনিতা পাঠ ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছেন, এই পুথিকারের নামটি একেক জায়গায় একেকভাবে এসেছে। কোথাও ফকির গরীবুল্লাহ বেপারী। কোথাও পাওয়া যায় ফকীর গরীবুল্লাহ নামে। আমি তার যেসব পুঁথি দেখেছি সেসবের কোনটিতে ‘বেপারী’ বা ‘ফকীর’ শব্দের উল্লেখ পাইনি। বরং পুথিকার নিজে তার পরিচয় দিয়েছেন মুন্সি গরীবুল্লা নামে।

গরীবুল্লার বাড়ি ছিল ঢাকার রহমতগঞ্জে। পিতা কালু মাঝি ওরফে রফিক মোল্লা থাকতেন হাজারিবাগে। ভাইয়ের নাম জঙ্গু কারিগর। লালবাগের বাসিন্দা। তাদের কার কী পেশা সে ব্যাপারে কিছু অনুমান হয়তো করা যায়। সঠিক কোন তথ্য নেই। গরীবুল্লা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কী ব্যবসা সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ছোটখাটো ব্যবসা। 
ব্যবসা ও পুঁথি দুটি দুই মেরুর। জীবিকার প্রয়োজনেই হয়তো ব্যবসা করতেন। আর গভীর বোধ ও চর্চায় ছিল পুঁথি। মুন্সি গরীবুল্লা ঢাকার পাশাপাশি কলকাতারও বাসিন্দা ছিলেন। কারও কারও মতে, তার বেশিরভাগ পুঁথি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। এক লেখায় আবদুল কাইউম দাবি করেছেন, গরীবুল্লার সব পুঁথিই প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। 
মুনতাসীর মামুন অবশ্য এ তথ্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। তার মতে, ঢাকা থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল মুন্সি গরীবুল্লার পুঁথি। বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, এক ভনিতায় আছে, তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ধরে নেয়া যেতে পারে, বোহেমিয়ান ছিলেন। এক সময় চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে তার লেখা সব পুঁথি কলকাতার বটতলা থেকে প্রকাশ হয়েছিল। পরে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় বসে লেখা পুঁথি প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকেই।  
পুঁথিগুলো বাংলা ভাষায় লেখা। তবে শুধু বাংলায় বলা যাবে না। আরবি ফারসি উর্দু হিন্দি ভাষার শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণে সম্ভবত দোভাষী পুঁথি হিসেবেও পরিচিত ছিল। আরও অনেকের মতো মুন্সি গরীবুল্লার পুঁথিও মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় রচিত কাব্য দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। এসব পুঁথির মূল বিষয় ছিল ধর্ম। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হতো। তবে অন্য ধর্মের প্রতি কোনো রূপ বিদ্বেষ বা বৈষম্য দেখানো হতো না। 
মুন্সি গরীবুল্লার কিছু পুঁথির কথা উল্লেখ করা যাক। তার রচিত ‘রৌসানল মোমেনিন’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। পরের বছর ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘দেল রৌসন।’ দুই বছর পর ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইবলিছ নামার পুঁথি।’ বেশ কয়েক বছর পর ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘নেক বিবির কেচ্ছা।’ ‘দেলরাম’ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। ১৮৮৫ সালে আসে ‘শের মশগুল।’ ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘শাহ্ পরীর পুঁথি।’ ‘ইউসুফ জোলেখা’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে।   
‘নেক বিবির কেচ্ছা’ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা যেতে পারে, সেখানে পুঁথির শুরুতে স্রষ্টার বন্দনা করে লেখা হয়েছে, ‘হক্কের হাকিম আল্লা বড় মেহেরবান। পলকে করিল জেবা জমীন আছমান। আপনি মেহের করে বান্দাকে পেলায়। সবাকে পেলায় নিজে আপ্নে নাহি খায়...।’ পরে ধীরে ধীরে কাহিনীর বিভিন্ন চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা ও এর মাধ্যমে এগিয়ে নেয়া হয়েছে কাহিনী। 
পুঁথি সাধারণত কয় পাতার হতো, মূল্য কেমন ছিল সেসব সম্পর্কেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৭৫ পৃষ্ঠার ‘শের মশগুল’র মূল রাখা হয়েছিল ১ টাকা। ৬৪ পৃষ্ঠার ‘শাহ্ পরী পুঁথি’ বিক্রি হতো ৪ আনায়।  
তবে বর্তমানে পুরান ঢাকার বিচিত্র বিষয় নিয়ে গবেষণা লেখালেখি ইত্যাদি হলেও পুঁথি সাহিত্য অবহেলিত রয়ে গেছে। ঢাকার পুঁথি বা পুথিকার সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম তেমন কিছু জানে না। মুন্সি গরীবুল্লার রচনার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। এসব পুঁথির কতগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। তার এবং অন্যদের পুঁথি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। দাবি রাখে।

×