ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজও ভেবে রোমাঞ্চিত হন সাবেকরা

জোয়ারের কালে দর্শকশূন্য ফুটবল, দেশের ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

জোয়ারের কালে দর্শকশূন্য ফুটবল, দেশের ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা

দেশব্যাপী চরম উত্তেজনা ও বহু নাটকীয়তার পর ১৯৮৭ সালে দর্শকশূন্য আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়

দেশে একসময় জোয়ার ছিল ফুটবলের। সেই জোয়ার যখন তুঙ্গে, যখন খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে হুমড়ি খেয়ে পড়ত দর্শকরা তখনই কিনা ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। দর্শক ঠেকাতে স্টেডিয়ামের  সব গেটে তালা দেওয়া হলো। গ্যালারি যখন শূন্য, মাঠে আয়োজন করা হলো প্রথম বিভাগ ফুটবলের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। ভাবা যায়? আশ্চর্যজনক হলেও, ঘটনা কিন্তু সত্য।

’৮০-এর দশকের বিচিত্র ম্যাচের সাক্ষী হয়েছিল ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম। আর খেলাটি যে আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যে হয়েছিল, সে তো বলাই বাহুল্য। চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সমর্থকদের মধ্যকার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নেওয়া হয়েছিল এই ব্যবস্থা। বিচিত্র এই উদ্যোগ দেশের ফুটবলের ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা হয়ে আছে।  
ইতিহাসের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাটি ১৯৮৭ সালের। ওই বছরের লিগ একটু বেশিই জমজমাট ছিল। আবাহনী-মোহামেডান তখন প্রায় সমান শক্তির দল। কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। উভয় দলেই নামকরা সব খেলোয়াড়। পাশাপাশি সে সময়ের বিখ্যাত অনেক বিদেশী ফুটবলারকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে দলে নেওয়া হয়েছিল। আবাহনীতে ছিলেন ইরাকের দুই তারকা সামির শাকির ও করিম মোহাম্মদ আলভী।

মাত্র এক বছর আগে ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে খেলে এসেছিলেন তারা। মোহামেডান এনেছিল ইরানের তিন ফুটবলার নালজেগার, মোর্তজা ও বোরহানজাদেহকে। নাইজিরীয় ফুটবলার এমেকা ইজিউগোকেও দলে নিয়েছিল তারা। ইরানি গোলরক্ষক নাসের হেজাজি সে মৌসুমে মোহামেডানের কোচের দায়িত্বও পালন করছিলেন। অর্থাৎ দুই দলেরই প্রস্তুতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।  
লিগের নির্ধারিত শেষ ম্যাচে ঢাকা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় আবাহনী-মোহামেডান। ম্যাচটি ছিল নাটকীয়তায় ভরা। মোহামেডান তখন ২ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিল। ফলে সমীকরণ এমন দাঁড়িয়েছিল যে, এগিয়ে থাকা আবাহনী এ ম্যাচ জিতলে তো বটেই, ড্র করলেও চ্যাম্পিয়ন হবে। কিন্তু মোহামেডান জিতলে আয়োজন করা হবে একটি প্লে অফ ম্যাচের। ৬ সেপ্টেম্বর ম্যাচ মাঠে গড়ালে প্রথমে মোহামেডানের পক্ষে গোল করেন মোর্তজা।

পরে আবাহনীর অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও শ্রীলঙ্কান ফুটবলার প্রেমলাল গোল করেন। ২-১ গোলে আবাহনী জিতে মাঠ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখন আবাহনীর বিরুদ্ধে প্যানাল্টি দিয়ে বসেন রেফারি। গোল করে সমতা আনে এমেকা। কিন্তু আরও একটা গোল হজম করতে হবে, আবাহনীর কেউ তা ভাবতেও পারেননি।  মোহামেডানের খুরশিদ আলম বাবুল তৃতীয় গোলটি করে বসেন। ৩-২ গোলে আবাহনীকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় তারা। এর ফলে দুই দলের পয়েন্ট সমান হয়ে যায়। কী কা-!
এ অবস্থায় ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় প্লে অফ ম্যাচের। এ ম্যাচে ফল আসতেই হবে। সে বিবেচনায় ঠিক করা হয়, নির্ধারিত সময়ের পরও ফলাফল শূন্য থাকলে অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে খেলা। এতেও ফল না পাওয়া গেলে বেছে নেয়া হবে টাইব্রেকারের পথ। সঙ্গত কারণেই ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। খেলা শুরু হলে বিবাদে জড়িয়ে পড়তেও সময় নেন না দুই দলের  ফুটবলাররা। আবাহনীর গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন মোহামেডানের ইরানি ফুটবলার নালজেগারের ওপর হামলে পড়েন।

এ ঘটনা ডাল পালা ছড়াতে থাকে দ্রুত। দুই দলের খেলোয়াড়দের ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। রেফারি লাল কার্ড দেখান মোহামেডানের ডিফেন্ডার আবুল হোসেন ও আবাহনীর মিডফিল্ডার মোস্তফা কামালকে। মহসিন ও  ইলিয়াস হোসেনকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করা হয়। গ্যালারিতেও ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটে। টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ উত্তেজনা।
অন্যদিকে ৯০ মিনিটের খেলা থেকে যায় গোলশূন্য। উল্টো ফুটবল রেখে শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি। গ্যালারিতেও ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ উত্তেজনা।
অন্যদিকে ৯০ মিনিটের খেলা সেদিন গোলশূন্যই থেকে যায়। অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরু হবে, সে মুহূর্তে আবারও নাটক। এবার একেবারেই বিপরীত ঘটনা। আবাহনী-মোহামেডানের খেলোয়াড়রা নিজেরাই নিজেদের যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে খেলা শেষ করে দেন। চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের এমন মিলমিশ ফুটবলের প্রকৃত সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। আজও ইতিহাস হয়ে আছে সেই ঘটনা।
তবে ওই ঘটনাও শেষ ঘটনা ছিল না। খেলোয়াড়দের নেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। তারা সন্ধি প্রক্রিয়ায় থাকার অভিযোগে মোহামেডানের অধিনায়ক রণজিত সাহা ও আবাহনীর অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ আসলামকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। আবাহনীর মোহাম্মদ মহসিন, মোস্তফা কামাল এবং মোহামেডানের আবুল হোসেন ও ইলিয়াস হোসেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তিন মাসের জন্য। এর পর প্রায় দেড় মাস ধরে ম্যাচ নিয়ে চলে নানা তর্কবিতর্ক।

বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা ঘটে। অবশেষে ঠিক হয়, ২৬ অক্টোবর প্লে অফ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ততদিনে দেশের নানা স্থানে সমর্থকদের মধ্যে ভয়ংকর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে প্রাণহানির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাও। খেলা দেখতে এসে তারা আবারও সংঘর্ষে জড়াতে পারেন, এমন শঙ্কা করছিলেন সবাই। অগত্যা করা নিরাপত্তার মধ্যে দর্শকশূন্য মাঠে খেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়।  
কেমন ছিল সেই খেলা? কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল? জানতে কথা হয় মোহামেডানের তারকা খেলোয়াড় কায়সার হামিদের সঙ্গে। স্মৃতি    রোমন্থন করে তিনি বলেন, দুপুর ৩টার দিকে শুরু হয়েছিল খেলা। জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো দর্শকশূন্য মাঠে খেলতে নেমেছিলাম। তখন তো আমাদের প্রাকটিস দেখতেই ৮ থেকে ১০ হাজার লোক জমা হয়ে যেত। সেখানে আবাহনীর মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলতে নেমে দেখছি, গ্যালারি খাঁ খাঁ করছে। এ অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো যাবে না।

আসলে এত ঘটনার পর আয়োজকরা কোনো ঝুঁকিই নিতে চাননি। এ কারণেই ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের খেলা নিয়ে যাওয়া হয় সেনা নিয়ন্ত্রিত আর্মি স্টেডিয়ামে। খেলা চলাকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রসহ পাহারা বসিয়েছিলেন। এর পরও অনেক দর্শক মাঠে ঢোকার শেষ চেষ্টা করেছেন বলে জানান তিনি। বলেন, লম্বা সময় ধরে অদূরে বহু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি।
আবাহনীর অধিনায়ক আসলামের সঙ্গে কথা বলে আরও মজার তথ্য পাওয়া যায়। পেছনে ফিরে গিয়ে কৃতী ফুটবলার বলেন, গোটা গ্যালারিতে ২০ থেকে ৪০ জনের মতো দর্শক ছিলেন। এই দর্শকদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম! আমি তেমন কিছুই জানতাম না। এর পরও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আমাকে। তাই গ্যালারিতে বসে খেলা দেখে কাটিয়েছি। গা হাত পা নিশপিশ করছিল। কিন্তু কিছু করার ছিল না। দর্শকই থাকতে হয়েছে। দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনে এভাবে দর্শক হওয়ার ঘটনা আর কখনো ঘটেনি বলে জানান তিনি।
খেলার ফলাফল কী হয়েছিল? তার আগে জানাই, ততদিনে আবাহনীর ইরাকি ফুটবলাররা দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। মূল গোলরক্ষক মহসিন নিষেধাজ্ঞার কারণে খেলতে পারেননি। মধ্যমাঠের সেরা খেলোয়াড় মোস্তফা কামাল, অধিনায়ক আসলামকে, আগেই জানিয়েছিল, মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল। আবাহনী তাই খেলতে প্রথমে রাজি ছিল না। এক পর্যায়ে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ৯ খেলোয়াড় নিয়ে খেলবে বলে জানায়।

অবশ্য শেষতক ১১ জন নিয়েই মাঠে নামে তারা। মোহামেডানে অবশ্য  নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি অত আমলে নেয়নি। বরং ম্যাচের আগে আগে নাইজিরিয়া থেকে এমেকাকে নিয়ে আসে তারা। এসব ঘটনা দুর্ঘটনার প্রভাব ভালোভাবেই পড়ে খেলায়। ২-০ গোলে জিতে লিগ শিরোপা নিজেদের করে নেয় মোহামেডান। মোহামেডানের এটি ছিল টানা দ্বিতীয় লিগ শিরোপা। জানিয়ে রাখা আবশ্যক যে, ম্যাচটি টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। এর ফলে সারাদেশের মানুষই দেখেছেন। কিন্তু মারামারি করার তেমন সুযোগ পাননি!

×