ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রূপপুর বাজারে রোপণ করা সেই কড়ই গাছ

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় বিবিসি রেডিও শোনা...

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৫ ডিসেম্বর ২০২২

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় বিবিসি রেডিও শোনা...

মুক্তিযুদ্ধকালে উত্তরবঙ্গের রূপপুর বাজারে রোপণ করা কড়ই গাছ এখন বিশাল বৃক্ষ

উত্তরবঙ্গের রূপপুর বাজারে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিবিসি রেডিও শোনার দিনগুলোতে রোপণ করা সেই কড়ইগাছ ৫১ বছরে মাখা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অনেক শাখা-প্রশাখা মেলেছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণায় গাছেরও প্রাণ আছে। গাছ কথা বলে। সেই তত্ত্বে রূপপুরের কাশেম মোল্লার লাগানো এই কড়ই বৃক্ষ পথচারী ও ক্লান্ত পথিকদের ছায়ায় ঢেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কতই না কথা কইছে। বৃক্ষ স্মরণ করে কাশেম মোল্লাকে। স্মরণ করে বাঙালির গর্বের মুক্তিযুদ্ধ। বৃক্ষপ্রেমীরা হয় তো কান পেতে তা শুনতে পায়।
কে ছিলেন এই কশেম মোল্লা! কি ছিল সেদিনের রূপপুর বাজারে। অতীত জানিয়ে দেয় : পাবনা জেলার ঈশ^রদী উপজেলার একটি ছোট্ট বাজার রূপপুর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দুই কিলেমিটার আগে মূল সড়ক থেকে দক্ষিণের দিকে যে রাস্তা চলে গেছে সেই পথ ধরে এগোলেই রূপপুর বাজার। সেদিনের রূপপুর বাজার ছিল গ্রামের কাঁচা মেঠো পথের ধারে। কয়েকটি ছোট্ট ঝুপরিঘর নিয়ে ছিল পরিচিতি। যেখানে রূপপুর গ্রামের এক কৃষকের ছেলে তরুণ কাশেম মোল্লার চায়ের দোকান ছিল। গোধূলিবেলা থেকে সন্ধ্যার পর অনেকটা সময় গ্রামের লোকজন সেখানে বসত। চা পান করত। আলাপচারিতায় মেতে উঠত। কাশেম মোল্লা তার তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও নিয়ে বসতেন দোকানে। গান শোনাতেন। খবর শোনতেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতের পর গ্রামের এই বাজার দিনা কয়েক বন্ধ ছিল। এপ্রিলের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবর জানতে শর্টওয়েভে বিবিসি রেডিও শোনার পালা শুরু করেন কাশেম মোল্লা। একজন দুইজন করে ক’দিনের মধ্যে জ্যামিতিক হারে লোক সমাগম ঘটতে থাকে। লোকজন ভয়ভীতি উপেক্ষা করে লাঠিসোটা নিয়ে ওই বাজারে কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বসে রেডিও শুনতেন। কাশেম মোল্লা তারুন্যের উদ্দীপনায় মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর শুনিয়ে লোকজনকে বিশেষ করে তরুণদের উদীপ্ত করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিজয়ের দিন এবং তারও পরের অনেকটা সময় কাশেম মোল্লার দোকান ছিল বিবিসি রেডিও শোনার কেন্দ্র। একাত্তরের এপ্রিল মাসেই রেডিও শোনা থেকে লোকমুখে এই বাজারের নামকরণ হয় বিবিসি বাজার। কাশেম মোল্লা যেদিন থেকে বিবিসি রেডিও শোনার আয়োজন করেন সেই সময়ে চায়ের দোকানের সামনে রোপণ করেন একটি কড়ই বৃক্ষের চারা। এ বছর (২০২২) সেপ্টেম্বরের শেষ দিন বিবিসি কর্তৃপক্ষ  বাংলা ভাষায় রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। বিবিসি বেতার বন্ধ হয়েছে। তবে রূপপুর বাজারের কড়ই গাছটি বিবিসি বেতারের বাংলা ভাষায় প্রচরিত মুক্তিযুদ্ধের খবর শোনার দিনগুলো শাখা-প্রশাখায় ধরে রেখেছে। সেই কড়ই গাছ আজ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর রেডিও শোনার অধ্যায় ধরে রেখেছে।
কাশেম মোল্লা আজ আর নেই। বার্ধক্যজনিত কারণে ক’বছর আগে গত হয়েছেন। তবে রেখে গেছেন তার স্মৃতি। তার রোপিত কড়ই গাছ। ১৯৯৭ সালে এই প্রতিবেদক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও পদ্মা সেতুর ওপর একটি প্রতিবেদন করার সময় সাক্ষাৎ হয় কাশেম মোল্লার সঙ্গে। তখন তিনি পাকশী রেলওয়ে মার্কেটে মিষ্টির দোকান দিয়েছিলেন। অসুখে ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হলে লাঠি ভর করে হাঁটতেন। ওই সময় তিনি জানান, ১৯৬২ সালে বিয়ের সময় তিনি সেই রেডিও কিনেছিলেন। স্ত্রী ৫ মেয়ে ৪ ছেলে নিয়ে তার সংসার। সেই রেডিও তার উত্তরসূরিরা এনটিকস হিসেবে হয় তো রেখেছেন। এখন এলাকার লোকজন বলেন মুক্তিযুদ্ধে মানুষের খবর শোনার ভরসাস্থল ছিল রূপপুর বাজারের রেডিও বিবিসি। গ্রামের মানুষকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিলেন কাশেম মোল্লা। একপর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হলে চায়ের দোকানে সেই অনুষ্ঠানও শুনত লোকজন। ওই সময় গ্রামের অনেকের ঘরে রেডিও ছিল না।
দেশে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিবিসি বাজারের কথা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসির সাংবাদিক ওই বাজারে গিয়ে দেখে আসেন সেই ঝুপরি দোকান। ১৯৯২ সালে বিবিসির সুবর্ণ জয়ন্তিতে রূপপুর বাজারে অনুষ্ঠান হয়েছিল। কিালের বিবর্তনে রূপপুরে সেই বিবিসি বাজারের কাছেই দেশের অন্যতম মেগাপ্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। রূপপুর এলাকায় এখন ২০টি বহুতল ভবন। যেখানে থাকে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মানকারী রাশিয়ান বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীগন। কাছেই রূপপুর বাজারে কাশেম মোল্লার রোপন করা কড়ইগাছ শাখা-প্রশাখা মেলে বিশাল বৃক্ষে পরিণত। ক্লান্ত পথিক ও লোকজন এই গাছতলায় বসে। গাছেরও প্রাণ আছে। সেই কড়ইগাছ মুক্তিযুদ্ধে বিবিসি শোনার দিনগুলোর গল্প শোনায়।

 

×