ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাদুর প্রদীপ

জুয়েল আশরাফ

প্রকাশিত: ২২:২০, ৭ অক্টোবর ২০২২

জাদুর প্রদীপ

.

পুরনো আমলের প্রকান্ড একটি বাড়ি। বাড়িটি শিমুলের দাদার। শিমুল, অংকন, রিতা ভাইবোন। তিনজনই রোজ বাড়ির আনাচে-কানাচে খেলে। আজ খেলার ফাঁকে চোখ বন্ধ করে অংকন বলল, চলো সবাই তাড়াতাড়ি লুকাই। আমি দশ পর্যন্ত গুনব।

শিমুল ও রিতা লুকানোর জন্য বাড়িতে এদিক ওদিক দৌড়ে যায়। দুজনেই দাদার ঘরের কাছে পৌঁছে গেল। শিমুল দরজা খুলতেই রিতা বাঁধা দিয়ে বলল, পাগল! দাদার ঘরে ঢুকতে নেই। উনি অসুস্থ।
শিমুল বলল, আমি জানি। কিন্তু আজ দাদা নেই। তোমার হয়তো মনে নেই, চাচা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন। চলো তাড়াতাড়ি ভেতরে যাই।
দুজনেই লুকানোর জায়গা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একটা বইয়ের পুরনো আলমারি দেখতে পেল। এত বড় যে সহজেই ভেতরে ঢোকা যায়। দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। শিমুলের পকেটে একটি টর্চ লাইট রয়েছে। পকেট থেকে বের করে এখানে-সেখানে আলো ফেলল। রিতার খুব ভয় লাগছে। কিন্তু শিমুল তাকে সাহস ধরে রাখতে বলল। কৌতূহলবশত দুজনেই দাদার গুপ্তধন দেখতে লাগল। হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল একটা চকচকে জিনিসের ওপর।
রিতা ভয়ে ভয়ে জিনিসটি তুলে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে।
শিমুল ভাই, এটা তো...।
রিতা কিছু বলার আগেই শিমুল বলল, প্রদীপ!
রিতা কোমল গলায় বলল, আমাদের অংকন ভাইকে দেখানো উচিত। সে বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে, তাই না?
শিমুল রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, পাগল নাকি? বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রদীপের কি সম্পর্ক?
দুজনেই নিঃশব্দে আলমারি থেকে বেরিয়ে এসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অংকন রান্নাঘরে তাদের খুঁজছে। দুজনেই চুপচাপ তাকে ঘরে আসার ইশারা করল।
কী আজব তোমরা! এতক্ষণ ধরে তোমাদের খুঁজছি আর তোমরা দুজনে না জানি কোথায় লুকিয়ে ছিলে। আমি আর খেলব না।
ঘরে ঢুকে বলতে বলতেই কান্না শুরু করল অংকন।
ইশ্... চুপ। শান্ত হও অংকন। দেখো আমরা দাদার ঘর থেকে কী পেয়েছি?
অংকনকে প্রদীপ দেখিয়ে বলল শিমুল।
অংকন আঁৎকে উঠে বললো, কী! তোমরা দুজনে দাদার ঘরে লুকিয়ে ছিলে? কেউ দেখেনি?
রিতা বিরক্ত হয়ে বলল, উফ... অংকন ভাইয়া... শোনো আমরা কি বলছি।
অংকন শান্ত হলে শিমুল তাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। অংকন প্রদীপটা হাতে নিয়ে বলল, আমাদের দাদার একটা প্রদীপ আছে! এটা শুনতে কতই না আনন্দ লাগছে। কিন্তু এটা কি কোন জাদুর প্রদীপ?
রিতা বলল, তাই তো ভাই!
অংকন বলল, আজ রাতে একটা কাজ করি, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, পেছনের উঠানে আমরা লুকিয়ে আসব। এটি ঘঁষে দেখব। এটি একটি জাদুর প্রদীপ হতে পারে!
তিনজনের এই সিদ্ধান্তই হয়েছে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর ওরা তিনজনই প্রদীপ নিয়ে বাড়ির উঠানের পেছনে পৌঁছাল। এখন প্রশ্ন হলো, কে ঘঁষবে? শিমুল বড় হওয়ায় দুজনেই তাকে প্রদীপ ঘষতে বলল।
শিমুল ভয়ে প্রদীপ ঘষতে লাগলো। কিন্তু কিছুই হলো না। সে আবার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই ঘটল না। অংকন শিমুলের হাত থেকে প্রদীপ কেড়ে নিয়ে রাগ করে ঘঁষল। কিন্তু সেও ব্যর্থ হয়। সে রেগে গিয়ে পানিভর্তি বালতিতে প্রদীপ রাখল। তারপর হঠাৎ বালতি থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। দেখতে পেল তা থেকে পেট মোটা একটি সুন্দর জিন বেরিয়ে আসছে।
তিনজনই হতভম্ব। একটু পর জিনের এই রূপে দেখে সবাই হাসতে লাগল। রিতা জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই জাদু জান?
ভুঁড়িওয়ালা জিন বললো, ঠিক! কী চাও আমার কাছে?
সঙ্গে সঙ্গেই তিনজনই মিলে বিভিন্ন অনুরোধ করে বলল, এখনই আমাদের জন্য আইসক্রিম, চকলেট, কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এসো।
আমি তো তোমাদের হুকুম পালনের জন্য হাজির!
আর এই বলে জিন হাততালি দিয়ে তিনটি জিনিস তাদের সামনে পেশ করল। তিনজনই আনন্দের সঙ্গে তাদের পছন্দের জিনিস খেলো।
শিমুল বলল, আচ্ছা জিন ভাইয়া, আমরা তোমাকে যা বলব তা মেনে চলবে!
জিন বলল, ওস্তাদ, আমি এমন কিছু করি না যাতে কারোর ক্ষতি হয়। বাকি তোমাদের সব ইচ্ছা আমি পূরণ করব।
তিনজনই খুশি হয়ে গেল। তাদের স্কুল ব্যাগে প্রদীপ লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন তিনজনের জীবনই বদলে গেছে। যখনই কিছু খেতে মন চায়, তখনই প্রদীপে পানি ঢেলে জিনকে ডেকে খায়। একদিন শিমুল প্রদীপ থেকে জিনকে ডেকে বলল, জিন ভাইয়া, আমার পড়াশোনার কাজটা করে দাও।
জিন বলল, আমি দুঃখিত ওস্তাদ। এটা আমি পারব না।
শিমুল রেগে গেল। বলল, কিন্তু কেন? তুমি আমাদের প্রতিটি আদেশ পালন করবে, তাই না?
ওস্তাদ, এতে তোমারই ক্ষতি। আমি যদি তোমার জন্য তোমার পড়াশোনার কাজ করি তাহলে তুমি কিভাবে শিখবে?
কয়েকদিন পর দাদার শরীর হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ডাক্তাররা ব্যর্থ হলেন। ডাক্তার বললেন, এখন শুধু একটি অলৌকিক কাজ তাকে বাঁচাতে পারে।
শুনে শিমুল বলল, আমাদের একটা জিন আছে, ঠিক আছে। সে অলৌকিক কাজ করবে। দাদু সুস্থ হয়ে যাবে।
অংকন বলল, হ্যাঁ, জিনকে ডাকি।
তিনজন প্রদীপ থেকে জিনকে ডাকল।
জিন আসার সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি হাজির ওস্তাদ। তোমরা কি খাবে?
শিমুল বলল, আজ আমাদের কিছু খাওয়ার নেই। আমাদের দাদা খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলছে এখন একটা অলৌকিক কাজই তাকে বাঁচাতে পারে। দয়া করে এমন একটা অলৌকিক কাজ কর আমাদের দাদাকে বাঁচাও।
আমি দুঃখিত ওস্তাদ। আমি এটা করতে পারি না।
শিমুল জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কেন? এতে কার ক্ষতি হবে?
জিন তার অক্ষমতার কারণ ব্যাখ্যা করে বলল, আমি অলৌকিক কাজ করে কারও জীবন বাঁচাতে পারি না। এটা সৃষ্টির বিরুদ্ধে। সৃষ্টির কিছু নিয়ম আছে। কেউ তা ভাঙতে পারে না। আমিও পারি না।
অংকন বলল, এটা ভুল। জাদু দিয়েই সব হতে পারে। তোমাকেই করতে হবে।
জীবন-মৃত্যুর কাজে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আমি যদি তাই করতাম... আমাকে গ্রাস করা হবে।
দুদিনের মধ্যে দাদা মারা গেলেন। শিমুল, অংকন, রিতা তিনজনই এখন বুঝল দাদা কেন বাক্সে এই প্রদীপ রেখেছিলেন। কারণ এটা একটা প্রতারণা মাত্র। তারা প্রদীপটাকে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
শিমুল প্রদীপটিকে টুকরো টুকরো করে ভাঙল। সঙ্গে সঙ্গে জিনটি মুক্ত হয়ে তার পৃথিবীতে ফিরে গেল।

 

×