ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের বোতলবাড়ি

ভূমিকম্পরোধক, বুলেট প্রুফ ॥ ইটের চেয়ে ৮০ গুণ শক্ত

খোকন আহম্মেদ হীরা

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

ভূমিকম্পরোধক, বুলেট প্রুফ ॥ ইটের চেয়ে ৮০ গুণ শক্ত

বরিশালে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে নির্মাণাধীন বাড়ি

বাতিল মানেই ফেলনা নয়। এবার পরিবেশের ক্ষতিকারক রং-বেরঙের পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে ভূমিকম্পরোধক ও বুলেট প্রুফ বাড়ি নির্মাণকাজ শুরু করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন এক দন্ত চিকিৎসক। স্থানীয়দের কাছে বাড়িটি ‘বোতলবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
পাঁচকক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটির নির্মাণকাজ চলমান থাকতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বোতলবাড়ির একাধিক ছবি ভাইরাল হওয়ার পর গোটা বরিশালজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ছাদ ঢালাইয়ের কাজ বাকি থাকা বোতলবাড়িটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসুক মানুষ আসছেন। স্বপ্নের এ বোতলবাড়িটি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রামানন্দেরআঁক গ্রামের বাসিন্দা ও গৌরনদী মডেল থানা কমপ্লেক্সসংলগ্ন এলাকার দন্ত চিকিৎসক পলাশ চন্দ্র বাড়ৈ।
স্থানীয় বাসিন্দা রনজিত মিস্ত্রি বলেন, শুরুতে পলাশের ইচ্ছের কথা শুনে এলাকাবাসী তেমনভাবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। শুধু দেখেছেন ট্রাকে করে পলাশ প্লাস্টিকের বোতল বাড়িতে আনছেন। এরপর সেই বোতলগুলোর মধ্যে লোক দিয়ে বালু ভরাচ্ছে, আর বলছে এ দিয়েই বাড়ি বানাবে। কিন্তু কিভাবে বাড়ি হবে- তা তাদের মাথায় আসছিল না। একই গ্রামের স্বপন কুমার বলেন, প্রথমে বিষয়টি ভ্রƒক্ষেপ না করলেও যখন অবকাঠামোটি ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে যেতে থাকে, তখন সবাই অবাক হয়েছে। সবার মনের ভেতরেই অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করতে থাকে। আশপাশের সবাই এখন বোতলবাড়িটি দেখার মতো হয়েছে বলেই মন্তব্য করছেন। আশপাশের হাট-বাজারেও বোতলবাড়ি
নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে।
পলাশের বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ চন্দ্র বাড়ৈ বলেন, ইন্টারনেটে জাপানী প্রযুক্তির বোতলবাড়ি দেখে আমাদের কাছে পলাশ বোতল দিয়ে বাড়ি বানানোর কথা বলে। প্রথমে আমরা তাকে নিষেধ করি। পরে তার অনুরোধে বাড়ি বানানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছি। এখন দেখি ভালোই হয়েছে। সবাই বাড়ি দেখতে আসছে, পলাশের প্রশংসাও করছে। পলাশের স্ত্রী জুঁই রানী দাশ বলেন, নির্মাণাধীন বোতলবাড়ি দেখতে আসা মানুষের কাছে স্বামী পলাশ চন্দ্র বাড়ৈর প্রশংসা শুনে বেশ ভালোই লাগছে।
অভিনব পদ্ধতিতে বাড়ি নির্মাণের সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে ব্যাপক খুশি রাজমিস্ত্রী ও শ্রমিকরা। বোতলবাড়ি নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা বলেন, বাড়িটি নির্মাণে ইটের বদলে প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল আর বালু ব্যবহার করা হয়েছে। পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলগুলোর মধ্যে বালু ভরে তা ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ির দেয়ালের গাঁথুনি তৈরিতে। ইতোমধ্যে ইটের বদলে প্লাস্টিকের বোতল দিয়েই বাড়ির দেয়ালের গাঁথুনির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ির পাশের পুকুরের ঘাটলাও নির্মাণ করা হয়েছে বোতল দিয়ে।
রাজমিস্ত্রী মতি সিকদার বলেন, বিগত দশ বছর ধরে আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। বোতল দিয়ে বাড়ি বানানো এটাই আমার জীবনের প্রথম কাজ। পলাশের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করি। কাজ যতদূর করা হয়েছে, তাতে নিশ্চিত বাড়ির নির্মাণকাজ খুবই মজবুত হয়েছে। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ির তেমন কোন ক্ষতি হবে না। আসন্ন দুর্গাপূজার পর বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শুরু করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বোতলবাড়ি নির্মাণের উদ্যোক্তা পলাশ চন্দ্র বাড়ৈ বলেন, প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে এভাবে বাড়ি নির্মাণের প্রযুক্তিটা মূলত জাপানী। প্রযুক্তিটা আমার কাছে ভালো লেগেছে। কারণ, এ বাড়ির প্রতিটি দেয়াল শীতে গরম আর গরমে ঠাণ্ডা থাকবে। ফলে বাড়ির ভেতরটাও আবহাওয়া অনুযায়ী বসবাসের উপযোগী হবে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের বোতলগুলো ফ্ল্যাক্সিবল হওয়ায় এটা ভূমিকম্পরোধক। পাশাপাশি দেয়ালগুলো বুলেটপ্রুপ। আর বাড়িটি ইটের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি শক্ত।
তিনি আরও বলেন, ১৫শ’ ২৫ স্কয়ার ফিট বাড়িটির মাটির নিচে ফাউন্ডেশনের কাজে এক লিটারের বালুভর্তি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়েছে। আর ওপরের দেয়ালগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ২৫০ মিলিলিটারের বিভিন্ন কোমলপানীয়ের বালুভর্তি প্লাস্টিকের বোতল। সব মিলিয়ে বাড়িতে ৪৮ মণ যা গণনায় প্রায় ৭৫ হাজার পিস প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রকৌশলী শিপলু কর্মকার বলেন, এ ধরনের বাড়িতে খরচ কিছুটা কম হবে সেটা নিশ্চিত। তবে বোতলবাড়ি কতটা টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে বোঝা যাবে।

 

×