ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল পন্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়

দেয়াঙ পাহাড়ে চলছে খনন কাজ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

দেয়াঙ পাহাড়ে চলছে খনন কাজ

চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড়ে বহু শতাব্দী প্রাচীন পন্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে খনন কাজ চলছে

উপমহাদেশের বহু শতাব্দীর প্রাচীন ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে খনন কাজ চলছে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কাজ শুরু করেছে। দুই মাস ধরে চলবে খনন কাজ। চট্টগ্রাম মহানগরী সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ অংশে কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ে প্রাচীন ন্ডি বিহারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করতে চলছে এই খনন। উল্লেখ্য, দেয়াঙ পাহাড়টি কর্ণফুলী উপজেলা থেকে শুরু করে আনোয়ারা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত।

ন্ডি বিহার বিশ^বিদ্যালয়টি ছিল উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ঐতিহাসিকদের মতে, কর্ণফুলীর বড় উঠান জুলধা এলাকায় অষ্টম শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। পাল সাম্রাজের বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ অনেক ইতিহাসবিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার ইতিহাস রয়েছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ন্ডি বিহারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার লক্ষ্যে খনন কাজ উদ্বোধন করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চন্দন কুমার দে।

জানা যায়, বিলুপ্ত হওয়া ঐতিহাসিক ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে বেশ আগে। ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিনিধি দল সরেজমিন আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড় অঞ্চলে ন্ডিতবিহারের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করে। তবে মাঝে বিভিন্ন জটিলতায় থমকে ছিল। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড শ্রীলঙ্কার যৌথ অর্থায়নে প্রায় ১৫০ একর পাহাড়ি ভূমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে শুরু করা যায়নি এর খনন কাজ। দীর্ঘদিন যাবৎ বিষয়টি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ভাষা বিভাগের অধ্যাপক . জিনবোধী ভিক্ষু। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে চিঠি পাঠান। ২০১৬ সালে প্রথমে এটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটা পর্যন্ত খনন কাজ চলছে। এরপরে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে গবেষণা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনা দেন। চট্টগ্রামে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো দপ্তর না থাকায় কুমিল্লা এবং সিলেট বিভাগের অধীনে চলছে তা তদারকি। দুজন কর্মকর্তা আর আটজন কর্মীর মাধ্যমে প্রতিদিন খনন কাজ চলছে।

ন্ডি বিহারের বিলুপ্তি হবার কারণ সম্পর্কে ইতিহাস সংশ্লিষ্টরা জানান, আরাকানদের সঙ্গে মোগলদের বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে বন্দর শহর দেয়াঙ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলেই এটি ধ্বংস হয়ে বিলুপ্ত ঘটে।

সার্বিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যোগের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল যাত্রা জনকণ্ঠকে জানান, . জিনবোধী ভিক্ষুর একক প্রচেষ্টাকে একটি নাগরিক নিবেদনে পরিণত করার লক্ষ্যে তাকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। ফলে ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় একটি নাগরিক দাবিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, পর্যালোচনা এবং  বিশ্ব জার্নালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা রয়েছে। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে আনোয়ারাজুড়ে এটির অস্তিত্ব ছিল। বৌদ্ধ বিহার হলেও এখানে ১৮টি বিভাগ ছিল। জ্ঞানচর্চার জন্য আদর্শকেন্দ্র ছিল বিশ^বিদ্যালয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জ্ঞানীরা বৌদ্ধ বিহার তথা বিশ^বিদ্যালয়ে এসেছিলেন। ১৮টি বিষয়ে পাঠদানের কারণে বিশ্বজুড়ে এর খ্যাতি। জন্য চীনসহ বিভিন্ন দেশ এই বিহার পুনর্প্রতিষ্ঠায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে সরকারকে তারা পাঁচশকোটি টাকা দেওয়ার জন্য সম্মত হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্ডিতরা পাঠাদানে ছিলেন, যার অধিকাংশই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ চর্যাগীতের রচয়িতা। মূলত কারণে বিহারটি ন্ডি বিহার নামেই পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯১ সালেও পুনর্নির্মাণের আলোচনা ছিল। এরপর আবার থেমে যায়। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জিনবোধী ভিক্ষু চীনে গিয়েছিলেন। তখন চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ দেখান। সেই সূত্রে এই খনন কাজ অবশেষে শুরু হলো।

তিনি আরও বলেন, আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এটি বাংলাদেশকে আরও ব্যাপকভাবে পরিচিত করবে। দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হবে।

গবেষক ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয়গ্রন্থের লেখক জামাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, অষ্টম শতাব্দীর দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয়। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এরমধ্যে ন্ডি বিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১৬ শতাব্দীর দিকে। অতীশ দীপঙ্কর ন্ডি বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হারিয়ে যাওয়া বিশ^বিদ্যালয়ের সন্ধান মেলে ১৯২৭ সালের দিকে। ওই এলাকায় সফর আলী নামের এক ব্যক্তি ঘর নির্মাণের জন্য মাটি খনন করতেই বড় ধরনের একটি ধস সৃষ্টি হয়। এতে বেরিয়ে আসে পুরনো স্থাপত্যের অংশবিশেষ। উদ্ধার হয় ৬০টি বৌদ্ধমূর্তি। ওই সময়ে মূর্তিগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়াম, কলকাতা মিউজিয়ামসহ কয়েকটি জাদুঘরে রাখা হয়। চট্টগ্রামের নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারেও পুরনো কিছু মূর্তি রয়েছে, যেগুলো এই ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া। অনেক দেরি হয়ে গেলেও ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়েছে, যা আমাদের আশান্বিত করেছে। আমরা চাই, সেখানে আবারও এই নামেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক।

উইকিপিডিয়া তথ্যসূত্র মতে, ১৫১৮ সালে পর্তুগীজ বণিকদের আগমন ঘটে চট্টগ্রামে। ১৫৩৭ সালে তারা দেয়াঙ পাহাড়ে বসতি গড়ে তোলে। এছাড়া আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল দেয়াঙ। দেয়াঙ এক সময় ত্রিপুরা রাজাদের অধীনেও ছিল। ১৫৩৭ সালে সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে পর্তুগীজ বণিকদের দেয়াঙ পাহাড়ে কুঠি গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। ইতিহাসবিদদের মতে, চট্টগ্রামের প্রাচীন ন্ডি বিহার বিশ্ববিদ্যালয়টি এই দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থিত ছিল।

×